ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজো। ফাইল চিত্র।
বাড়িতে মা দুগ্গা আসছেন এক যুগেরও পরে। তা অঞ্জলি, সন্ধিপুজো কিচ্ছু থাকবে না?
নানা মহল থেকে যখন প্রশ্নের বাউন্সার ধেয়ে আসছে, তখন গুরুজন, সুহৃদবর্গকে শান্ত ভাবে বিষয়টা বোঝাচ্ছেন, বয়সে তুলনায় কাঁচা, আনকোরা এক কন্যে। সম্পর্কে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের তুতো, পাথুরিয়াঘাটার দর্পনারায়ণ ঠাকুরের বাড়ির মেয়ে, ৩৮ বছরের সৌরজা ঠাকুর বলছেন, “কুমোরটুলির একচালা মিষ্টি বাংলা ঠাকুর থাকলেও পুজো দূরের কথা, প্রাণপ্রতিষ্ঠাই হবে না। কোনও পুরুতঠাকুরও থাকছেন না!” অভূতপূর্ব এক শারদোৎসবে পুজোর সঙ্গে জড়ানো শিল্পী, ঢাকি, কারিগর— কাউকেই অবশ্য বঞ্চিত করতে রাজি নন তাঁরা। তবে ঠাকুরবাড়ির মেয়ের অনড় সিদ্ধান্ত, এই উৎসবে গঙ্গার দফারফা করে ভাসানও কখনও হবে না। মহালয়ায় আনন্দমেলা দিয়ে উৎসবের সূচনা আর দশমীতে আনন্দযাত্রায় এই উৎসবের শেষ, চুম্বকে এটাই পুজোর নির্যাস। এর মাঝে পুষ্পাঞ্জলির বদলে শিল্পাঞ্জলি। প্রসন্নকুমার ঠাকুর স্ট্রিটে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের ১৮৮৪ সালের রাজকীয় ভবন বা প্রাসাদ চত্বর ফি-সন্ধ্যায় সেই সব অনুষ্ঠানের মহড়ায় মাতোয়ারা বেশ কিছু দিন।
ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান জয়রাম ঠাকুরের পুত্রদের মধ্যে নীলমণি ঠাকুরের উত্তরপুরুষেরা ব্রাহ্ম হলেও, দর্পনারায়ণের বংশধারাটি হিন্দুই থেকে গিয়েছিল। বাড়িতে ঘটা করে দুর্গাপুজোও হত। সেই পুজো এই একুশ শতকের প্রথম দশকে এসে বন্ধ হয়ে গেল, যেমন অনেক সাবেক বড় বাড়িতেই ঘটেছে। কিন্তু পরিবারের এক কন্যার (যতীন্দ্রমোহনের প্রপৌত্রের কন্যা) উৎসাহে, দরকার মতো পৃষ্ঠপোষকতা জোগাড় করে পুরনো ঠাকুরদালানে সেই পুজো ফিরে এল। তা-ও ধর্মবিহীন অন্য চেহারায় এই ফিরে আসা, সে-ও এক আশ্চর্য কাণ্ড বটে!
সৌরজার মনে হয়েছে, পুজোর সবার রঙে রং মেশানোর চেহারাটা ব্রাহ্মণ পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে নানা ধরনের আচার-সর্বস্বতায় ঠিক সুরক্ষিত থাকে না। তিনি বরং এই শারদোৎসবের মূল সুরটিতে নানা পর্যায়ে প্রেরণার রসদ খুঁজেছেন পরিবারের অন্য একটি ধারার পূর্বপুরুষ রবীন্দ্রনাথের কাছে। শান্তিনিকেতনে শারদাবকাশের আগে আনন্দবাজারে পড়ুয়াদের নিজের হাতে গড়া শিল্পসামগ্রীর মেলার চল আ়ছে। এখানে আনন্দমেলা-য় লোকশিল্পের মেলার পাশাপাশি বাড়ির ছোটদের আঁকা ছবিও মেলে ধরা হবে। শারদোৎসবের অঙ্গ হিসাবে রোজই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপচার। সপ্তমীতে মেদিনীপুরের পটের গান, অষ্টমীতে বাউল গান, নবমীতে বর্ধমানের কবিগানেরও কমতি থাকছে না। সপ্তমীতে সৌরজার ভাই প্রমন্থমোহন ঠাকুর সরোদ পরিবেশন করবেন। নবমীতে ভরতনাট্যম শিল্পী তথা ইংরেজি সাহিত্যের কলেজশিক্ষিকা সৌরজা থাকছেন চণ্ডালিকা-র মুখ্য ভূমিকায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মনোজ মুরলী নায়ার এবং তাঁর সাংস্কৃতিক মঞ্চ ডাকঘর এই উদ্যোগটির শরিক। পুজোর ক’টা দিন নানা ধরনের স্টলে মেলাও জমবে। আর আনন্দযাত্রা-য় ঠাকুর কাঁধে চার জন কাহারের সঙ্গে থাকবে ধুতি, শাড়ির সাজপোশাকে এক চমকপ্রদ শোভাযাত্রা। বিডন স্ট্রিট, গিরিশ পার্ক, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ লাগোয়া তল্লাটে এক চক্কর ঘোরার অনুমতি মিলেছে। ঠিক হয়েছে, সবাই মিলে ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও, যাও গো এ বার যাওয়ার আগে’ গানটাই গাওয়া হবে।
কিন্তু ভাসান না-হলে প্রতিমার কী হবে? সৌরজার ইচ্ছে, কুমোরটুলিকেই আবার প্রতিমা ভেঙে কাঠামো ‘রিসাইকল’ করার জন্য তা ফিরিয়ে দেওয়া হোক! দুর্গাপুজোর নিখাদ উৎসব হয়ে ওঠার পথে এ ভাবেই মিলছে নতুন দিশা, ঠাকুর পরিবারেরই হাত ধরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy