Advertisement
E-Paper

কম বয়সে বিয়ে বন্ধ করা যায়নি এ শহরেও

বিডন স্ট্রিটের বাসিন্দা মেয়েটি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে গিয়েছিল। নবম শ্রেণিতে উঠতে না উঠতে বাড়ি থেকে পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ে অবশ্য টেকেনি বেশি দিন। দেড় বছরের মধ্যেই বাপের বাড়ি ফিরে আসে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে হাতের কাজ শেখা শুরু করেছে। ভবিষ্যতের দিশা আপাতত কিছুই পাচ্ছে না।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৬ ০৭:১৪

বিডন স্ট্রিটের বাসিন্দা মেয়েটি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে গিয়েছিল। নবম শ্রেণিতে উঠতে না উঠতে বাড়ি থেকে পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ে অবশ্য টেকেনি বেশি দিন। দেড় বছরের মধ্যেই বাপের বাড়ি ফিরে আসে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে হাতের কাজ শেখা শুরু করেছে। ভবিষ্যতের দিশা আপাতত কিছুই পাচ্ছে না।

রাজারহাটের যাত্রাগাছির বাসিন্দা আর এক কিশোরীও বাড়ির অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। তখন তার বয়স মাত্র তেরো। ছ’মাস পরেই তাকে ফেলে রেখে বর উধাও। সেই মেয়েও অন্তঃসত্ত্বা হয়ে বাড়ি ফেরে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন অভিভাবকেরা। ফের স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে তাকে। ইতিমধ্যে সন্তানের জন্মও দিয়েছে সে।

শুধু একটি বা দু’টি ব্যতিক্রমী ঘটনার উদাহরণ ভাবলে ভুল হবে। বহু প্রচার এবং সরকারি প্রকল্প সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সাম্প্রতিক রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে, এখনও খাস কলকাতা শহরে যথেষ্ট সংখ্যায় নাবালিকাদের বিয়ে হচ্ছে। কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় ৭৫০টি বাড়ি এবং ৮০৩ জন মহিলা ও ৯৫ জন পুরুষের উপরে গত বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে সমীক্ষা চালায় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। মন্ত্রকের হয়ে সমীক্ষাটি করেছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্সেস’। ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্‌থ সার্ভে-৪’ নামে সেই সমীক্ষার কলকাতা পর্যায়ের রিপোর্টে বলা হয়েছে— সমীক্ষকেরা ২০-২৪ বছর বয়সী ১৩ শতাংশ মেয়ের খোঁজ পেয়েছেন, যাঁদের বিয়ে ১৮-র আগেই হয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ১৫-১৯ বছর বয়সী এমন ৫ শতাংশ কিশোরীকে পাওয়া গিয়েছে, যারা ইতিমধ্যে সন্তানের মা হয়ে গিয়েছে বা অন্তঃসত্ত্বা। সাড়ে সাতশো বাড়ি এবং কিছু মহিলা-পুরুষের উপরে সমীক্ষাতেই যদি এই রিপোর্ট মেলে, তা হলে সার্বিক ভাবে অবস্থাটা আরও কতটা খারাপ তা আঁচ করা যায়।

চিকিৎসকেরা বারবার বলেছেন, আঠেরোর নীচে বিয়ে এবং মা হওয়া মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। এতে দু’জনেরই শরীরে হাজারো জটিলতা, এমনকী প্রাণসংশয়ও ঘটতে পারে। সেই জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সমীক্ষায় বিষয়টিকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্বভাবতই যে প্রশ্নটা বড় হয়ে উঠছে, তা হল— জেলায় হয়তো বা প্রচারের অভাব থাকতে পারে, প্রশাসনিক গড়িমসি থাকতে পারে, মানুষের সচেতনতায় ঘাটতি থাকতে পারে। কিন্তু রাজ্যের শিক্ষা, সংস্কৃতি, সচেতনতার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত কলকাতায় কেন এখনও শিশু-বিবাহ বা কিশোরী মায়ের দেখা পাওয়া যাবে? বিশেষত যখন দূর-দূরান্তের জেলায় কিশোরীদের বিয়ে রুখে দেওয়া, বিয়ে রুখতে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি পর্যন্ত চলে আসার ঘটনা ঘটে, বা মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প এত সফল হয়।

কন্যাশ্রীর মূল লক্ষ্যই ছিল নাবালিকাদের বিয়ে রোখা। তা হলে কলকাতায় এ ক্ষেত্রে সমস্যা কোথায়?

সমাজকল্যাণ দফতরের এক কর্তার মতে, কন্যাশ্রীতে অনেকটাই ফল হয়েছে, তবে একটা ফাঁক রয়ে গিয়েছে। প্রকল্পে মেয়েটির নামে যে থোক টাকা দেওয়া হয়, তা শুধু তার পড়াশোনা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্যই নির্দিষ্ট করে দিলে অকালে বিয়ে দেওয়া আরও অনেক কমবে। নারী-অধিকার আন্দোলনের অন্যতম কর্মী শাশ্বতী ঘোষের কথায়, ‘‘অবাক হচ্ছি না। কারণ আমি নিজেও কলকাতার শহুরে বস্তি এলাকা এবং নিম্নবিত্ত মহল্লায় অনেক বিবাহিতা নাবালিকাকে দেখেছি। কলকাতায় একটু নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ছাত্রীরা যে সব স্কুলে পড়ে, সেখানেও নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির মধ্যে এখনও বেশ কিছু বিবাহিতাকে পাওয়া যাবে।’’

কেন বিয়ে করছে এরা? শাশ্বতীদেবী বলেন, ‘‘মূলত পরিবারের আর্থিক অবস্থা ও পারিপার্শ্বিক চাপ, নিরাপত্তাহীনতা, স্বল্পশিক্ষার কারণে।’’

কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্পে জড়িত এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান অতীন্দ্রনাথ দাসের ব্যাখ্যা— কলকাতা ও আশপাশে আঠারোর নীচে মেয়েদের বিয়ের দু’রকম কারণ দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, অভিভাবকদের আর্থিক অবস্থা এত খারাপ যে, তারা সন্তানদের বাড়িতে প্রতিপালন করতে পারছেন না। আর দ্বিতীয়ত ছেলেমেয়েরাই পালিয়ে বিয়ে করছে। কলকাতার শিশু নিরাপত্তা কমিটির প্রধান ইন্দ্রাণী গুহ ব্রহ্মও আফশোসের সুরে বলছিলেন, ‘‘স্কুলে পড়তে পড়তে পালিয়ে বিয়ে করছে, মা হচ্ছে— এমন প্রচুর কেস পাচ্ছি। এর মধ্যে নামী ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রীও রয়েছে। এমন বেশ কিছু মেয়ের অভিভাবকেরা তাঁদের নাবালিকা মেয়ের গর্ভস্থ সন্তানকে হোমে রাখার আবেদন করে গিয়েছেন।’’

রাজারহাটে শিশু বিবাহ রোখার কাজ করছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সংস্থার কর্মী সোমা গুহ জানান, যাত্রাগাছি, বিষ্ণুপুর, লাউহাটির মতো জায়গায় প্রচুর নাবালিকার বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিয়ে দেওয়ার প্রধান কারণ মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব। আবার অনেকেই জমি বেচে কিছু থোক টাকা পাচ্ছেন। তা খরচ হয়ে যাওয়ার ভয়ে আগেই মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছেন। পরিবারের প্রবল চাপে তার প্রতিবাদ করতে পারছে না ছোট মেয়েগুলো।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy