নির্বাচনী দুপুরে খাঁ খাঁ ধর্মতলা। শনিবার। ছবি: সুদীপ ঘোষ।
নেতাজি নগর থেকে পার্ক স্ট্রিট আসতে মেরেকেটে কুড়ি মিনিট। সপ্তাহান্তে বিখ্যাত চেলো কাবাবের টেবিলে জায়গা পেতেও এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে হল না। কলকাতার জীবনটা কেন ৩৬৫ দিন এমন মসৃণ হয় না ভেবে আফশোস করছিলেন লাকি ও সন্দীপন। ভোটপুজো উপলক্ষে ছুটির এমন স্বাদটাই শনিবার তরুণ দম্পতির কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হয়ে থাকল।
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও শহরে এ দিনের মেজাজটাকে বন্ধের কলকাতার সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘‘কেমন ফাঁকা, কিন্তু কোনও উত্তেজনা নেই।’’
সেক্টর ফাইভে ‘নাইট ডিউটি’ মিটিয়ে কাকভোরে কসবায় বাড়ি ফেরেন সন্দীপন দাস। তাঁর দিন শুরু বেলা বারোটায়। ‘ছুটি’র দিনটা সাংসারিক ঝুটঝামেলায় নষ্ট না করে সটান উবের ট্যাক্সি বুক করে স্ত্রী লাকিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
দম্পতির বাড়ি কসবায় হলেও সন্দীপনের ভোট পুরনো পাড়ায়, গোলপার্কে। আর লাকির ভোট নেতাজি নগরে। ভাড়া করা ট্যাক্সিতে চেপেই দু’জনে নির্ঝঞ্ঝাট গণতান্ত্রিক দায়িত্ব সারেন। সফল ভোট-অভিযানের পরে অপারেশন চেলো কাবাব। ‘‘সত্যিই দিনটা দারুণ কাটল।’’— পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে বললেন লাকি।
যাদবপুর কানেক্টরের কাছের আবাসনের বাসিন্দা মা-মেয়ে শিখা ও অনন্যা রায়চৌধুরীর কাছেও ভোটপুজোটা স্রেফ উপলক্ষ। ছুটিটাই আসল। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী অনন্যাই দুপুরে খেয়েদেয়ে মাকে টেনে বাড়ি থেকে বার করেছেন। প্রথমে ভোটটা চুকিয়েই বাস পেয়ে যান ওঁরা। একদম ফাঁকা। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের শপিং মলে ‘শজারুর কাঁটা’-র টিকিটও মিলল সহজেই। যাদবপুরে ইতিহাসে এমএ-র ছাত্রী পিয়ালি মুখোপাধ্যায়ও পুণে থেকে ছুটিতে কলকাতায় ফেরা বন্ধু শুভম জানাকে হাওড়া থেকে দক্ষিণ কলকাতার মলে টেনে এনেছেন। এমন ঝুটঝামেলাহীন কলকাতা সফরের অভিজ্ঞতা কবে ঘটেছে, মনে করতে পারলেন না।
সরগরম বুথ-চত্বরের উত্তেজনা, গোলমালের বাইরে এই অন্য কলকাতাটাও দেখা দিয়ে গেল শনিবার। ফাঁকা, সুনসান রাস্তাঘাট। পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় ফাঁকা টেবিল। বিকেল পর্যন্ত শপিংমলের নামী রেস্তোরাঁ, ফুডকোর্ট ভাল ভাবে আড় ভাঙতেই পারেনি। ছুটির আমেজে শহরের পথে বেরোনো জনতার কাছে এমন বাধাবন্ধহীন কলকাতাই ভোটের উপহার হয়ে থাকল।
তবে ভোট থেকে দূরে থাকলেও ভোট ভুলে থাকা সোজা নয়। শ্যামবাজারে দেশবন্ধু পার্কে সকালে গা ঘামাতে গিয়ে যথারীতি দেখা হয়েছে স্কটিশের ’৭৭ সালের ব্যাচমেট সৌমেন রায় ও কিশোর বসাকের। শর্টস, জুতো পরে একপ্রস্ত ছোটাছুটি সেরে পার্কের বেঞ্চে বসতেই ঢুকে পড়ল ভোটের হাওয়া। ডাফ স্কুলের বুথের কাছে কোন উঠতি মাতব্বর সাত-সকালেই দুই শাগরেদকে বেলা ১১টার পরে সব কন্ট্রোলে নিয়ে নিস বলেছে!— তা নিয়েই দুই ইয়ারের গুলতানি শুরু।
দেখা গেল, বেলগাছিয়ার রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কর্মচারী দীপক ঘোষকেও পাড়ার পুরনো কংগ্রেস কর্মী রামকুমার ঝা ও তাঁর বন্ধুরা কোণঠাসা করে ফেলেছেন। দীপকের ভাই, তারকেশ্বরের তৃণমূল নেতা। অতএব মনোহর অ্যাকাডেমি স্কুলের বুথে ভোট দিতে যাওয়ার আগে রামকুমারদের আবদার, তোকেই আজ ফ্রি-তে কচুরি খাওয়াতে হবে! কং-তৃণমূলের কপট আকচা-আকচি বেশ জমে উঠল।
হাওড়া ব্রিজ, ধর্মতলা-চত্বর, গড়িয়াহাট পাড়ার জমজমাট চেহারাটা অবশ্য সন্ধে পর্যন্ত উধাও। রবিবারেও এমন জনহীন কলকাতা দেখা যায় না। তবে গলির ভিতরের ছবিটা অন্য। কয়েকটি এলাকায় বিক্ষিপ্ত মোটরবাইক-বাহিনী বুথমুখী জনতাকে সাঁ-সাঁ মেপে গেল। বিকেল তিনটের পরে অবশ্য শরৎ বসু রোডেই শাসকের আগাম বিজয়োৎসব শুরু হয়ে গেল। ততক্ষণে শহরের শপিংমল, সিনেমাহলগুলিও ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে। ভিড় বাড়ল সল্টলেক, রাজারহাটে। ভোটের দিন কলকাতার ‘ড্রাই ডে’-য় আর কোথায় যাবেন শহরের তৃষ্ণার্তেরা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy