Advertisement
E-Paper

ছাতা হারিয়ে পুলিশের সামনেই ফুঁসল গোপাল

মাথার উপর থেকে শাসকদলের ছাতা সরে যাচ্ছে, এটা আঁচ করেই সে কলকাতা ছেড়েছিল। বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার হওয়ার পরে পুলিশের সামনে শাসকদলের নেতাদের সম্পর্কে ক্ষোভ উগরেও দিল গিরিশ পার্ক কাণ্ডের অন্যতম মূল অভিযুক্ত গোপাল তিওয়ারি। লালবাজারের খবর, তেঘরিয়ার হোটেলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গোপাল আক্ষেপ করে বলেছে, ‘‘যাদের জন্য খাটলাম, তারাই বলির পাঁঠা করল! এখন কেউ নাকি আমাকে চিনতেই পারছে না!’’

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৫ ০৩:২৯
গোপাল তিওয়ারি

গোপাল তিওয়ারি

মাথার উপর থেকে শাসকদলের ছাতা সরে যাচ্ছে, এটা আঁচ করেই সে কলকাতা ছেড়েছিল। বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার হওয়ার পরে পুলিশের সামনে শাসকদলের নেতাদের সম্পর্কে ক্ষোভ উগরেও দিল গিরিশ পার্ক কাণ্ডের অন্যতম মূল অভিযুক্ত গোপাল তিওয়ারি। লালবাজারের খবর, তেঘরিয়ার হোটেলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গোপাল আক্ষেপ করে বলেছে, ‘‘যাদের জন্য খাটলাম, তারাই বলির পাঁঠা করল! এখন কেউ নাকি আমাকে চিনতেই পারছে না!’’

সাম্প্রতিক অতীতে একাধিক দুষ্কৃতী জালে পড়ার পরে একই খেদ প্রকাশ করেছে। যেমন, গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে সিআইডি-র হাতে পাকড়াও মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না (এসআই খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত তদানীন্তন ওই তৃণমূল বরো চেয়ারম্যান জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের বন্দর এলাকায় তৃণমূল নেতৃত্বের কাছাকাছি এসেছেন, এমনকী ছেলেকে তৃণমূলের টিকিটে কাউন্সিলরও বানিয়েছেন।) আবার মাঠপুকুরে তৃণমূল নেতাকে হত্যায় অভিযুক্ত দলীয় কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাও-ও গ্রেফতার হয়ে একই ভাবে মুখ খুলেছিলেন নেতাদের বিরুদ্ধে।

কিন্তু গোপাল শহরে ফিরে এল কেন? পুলিশের অন্দরেই প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু অফিসারের ধারণা, মাথা বাঁচাতে সে আদতে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। লালবাজার-কর্তৃপক্ষ যদিও এ হেন তত্ত্বে আমল দিচ্ছেন না। তাঁদের দাবি, গোয়েন্দাদের কৃতিত্বেই গোপাল জালে পড়েছে। তবে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় যে সে আর নেই, একাধিক গোয়েন্দা-কর্তাও তা কবুল করেছেন একান্তে।

১৮ এপ্রিল, অর্থাৎ কলকাতা পুরভোটের দিন গিরিশ পার্কের সিংহিবাগানে কংগ্রেস-তৃণমূল সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে এসআই জগন্নাথ মণ্ডল গুলিবিদ্ধ হন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মধ্য কলকাতার তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর দলীয় অফিস থেকে দু’জন তৃণমূল-সমর্থক গ্রেফতার হন। পরে লালবাজারের গোয়েন্দারা পাকড়াও করেন গোপাল-ঘনিষ্ঠ চার জনকে।

লালবাজারের খবর, গিরিশ পার্ক কাণ্ডে গোপাল ছাড়া যে দশ জনকে ধরা হয়েছে, তাদের ছ’জনই তৃণমূলকর্মী। পুলিশের একাংশের দাবি: ওই তল্লাটে সে দিন শাসক দলের হয়ে ভোট করাতে নেমেছিল গোপাল-বাহিনী, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল সঞ্জয়বাবুর হাতে। গোপাল নিজে রাস্তায় না-নামলেও পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতে বসে খোঁজ-খবর রাখছিল। প্রসঙ্গত, ক’দিন বাদে পুলিশ ওই বাড়িতেই তল্লাশি চালিয়ে বিস্তর বন্দুক-বিস্ফোরক উদ্ধার করে।

গিরিশ পার্ক কাণ্ড ঘিরে শোরগোল চলাকালীন গোপালের সঙ্গে এক মঞ্চে রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজার ছবি প্রকাশ্যে আসার ঘটনায় তৃণমূল-যোগের অভিযোগ জোরদার হয়। সঞ্জয়বাবু ও শশীদেবী দাবি করেন, গোপালকে তাঁরা চেনেন না। গোপাল গ্রেফতারের খবর শুনে শুক্রবার সঞ্জয়বাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘গোপাল ধরা পড়েছে তো আমার কী?’’

এটুকু বলেই সঞ্জয়বাবু ফোন কেটে দেন। পুলিশ বলছে, গোপাল যে বর্ণপরিচয়ের ‘সুবোধ বালক’ নয়, শাসকদলের নেতারা তা জানতেন। ২০০৫-এ পোস্তায় একটি খুনের চেষ্টার মামলায় গোপাল সে বছরে জেলে যায়। ২০১১-র মে মাসে সুপ্রিম কোর্টে শর্তসাপেক্ষ জামিন নিয়ে বাইরে আসে। ‘‘পালাবদলের রাজ্যে সে শাসকদলের নেতাদের সঙ্গে ভিড়বে, সেটাই স্বাভাবিক।’’— মন্তব্য এক অফিসারের। বস্তুত গত চার বছরে তৃণমূলের হরেক অনুষ্ঠানে গোপালের উপস্থিতি নজরে এসেছে। এমনকী গোপালের স্ত্রীরও দাবি, তাঁর স্বামী তৃণমূল-কর্মী। তা হলে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া সে হারাল কী ভাবে?

এখানে আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে আলিপুর-গোপালনগর-রাসবিহারীর পুলিশ নিগ্রহের ঘটনা। আলিপুরে থানা আক্রমণ ও গোপালনগর মোড়ে বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের সভায় হামলায় অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহা পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গিয়েছেন। অতি সম্প্রতি রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে ট্র্যাফিক কনস্টেবলকে নিগ্রহ ও থানায় পুলিশকে কাজে বাধাদানের জন্য যাঁর দিকে আঙুল, কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ভাইঝি সেই দেবপ্রিয়া সম্পর্কেও লালবাজার নিরুত্তাপ। এমতাবস্থায় গোপাল ব্যতিক্রম হল কী ভাবে, সেই প্রশ্নটা নানা মহলেই শোনা যাচ্ছে। যার জবাবে পুলিশ-কর্তাদের অনেকের ব্যাখ্যা, গোপাল দাগি অপরাধী হওয়ার সুবাদেই তাকে ঝেড়ে ফেলাটা সহজ হয়েছে।

লালবাজারের অন্দরের খবর, গোপাল-ঘনিষ্ঠ দিলীপ সোনকারও মধ্য কলকাতায় সক্রিয় তৃণমূলকর্মী হিসেবে পরিচিত ছিল। গিরিশ পার্ক কাণ্ডের জেরে তার মাথার উপর থেকেও নেতারা হাত তুলে নিয়েছেন।

ক’দিন আগে সে গ্রেফতার হয়। জানা যায়, ফেরার গোপালের কাছে তোলাবাজির টাকা হাওয়ালা মারফত সে-ই পাঠাচ্ছিল এক মাস ধরে। এ দিকে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ আর এক দুষ্কৃতী ‘হাতকাটা’ দিলীপ সম্প্রতি ধরা পড়ার পরে তাকেও লালবাজার হেফাজতে নেয়, কারণ গোপালের সঙ্গে তার যোগ রয়েছে বলে সন্দেহ ছিল। এই দুই দিলীপই হয়ে ওঠে পুলিশের তুরুপের তাস। কী ভাবে?

গোয়েন্দাদের দাবি, দিলীপ সোনকারকে ধরে গোপালের টাকার জোগান বন্ধ করে দেওয়া হয়। গোপাল বাধ্য হয় কলকাতায় ফিরতে। আর বৃহস্পতিবার রাত কাটানোর জন্য সে বেছে নিয়েছিল এমন একটা হোটেল, যেখানে হাতকাটা দিলীপের প্রতিপত্তি রয়েছে। ‘‘এমনটা হতে পারে আঁচ করে তৈরি ছিলাম। গোপাল হোটেলে ঢুকতেই তাকে পাকড়াও করা হয়।’’— বলছেন এক গোয়েন্দা-অফিসার।

শুক্রবার গোপালকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টের অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অঞ্জনকুমার সরকারের এজলাসে তোলা হয়। পুলিশ আদালতে জানায়, গোপালের কাছে ১৭০০ টাকা ও একটি ‘হনুমান চলিশা’ মিলেছে। গোপালের কৌঁসুলি লোকেশ শর্মা প্রশ্ন তোলেন, গিরিশ পার্ক-কাণ্ডের এফআইআরে গোপালের নাম না-থাকা সত্ত্বেও সে গ্রেফতার হল কেন? সরকারি কৌঁসুলি শুভেন্দু ঘোষের যুক্তি, ধৃতদের জবানবন্দির ভিত্তিতে গোপালের বাড়ি থেকে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার হয়েছে, বাকিদের গ্রেফতার করতেও গোপালকে জেরা করা জরুরি। সওয়াল-জবাব শেষে আদালত গোপালকে ১০ জুন পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয়।

গিরিশ পার্কের গুলিচালনা মামলায় অবশ্য এখনও অধরা রয়েছে রামুয়া, রাউয়া, রাজার মতো কিছু চুনোপুঁটি। কিন্তু যে ‘মাথা’দের মদতে গোপালের উত্থান, তাঁদের সম্পর্কে লালবাজার তথা প্রশাসন কী ভাবছে?

এই প্রশ্ন আপাতত অমীমাংসিতই।

Gopal Gopal Tiwari police Trinamool BJP congress girish park
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy