জেলা থেকে কলকাতায় এসে গাড়িঘোড়ার ভিড় দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন এক বৃদ্ধ। রোদে ঘুরতে ঘুরতে শেষমেশ এক পুলিশ কনস্টেবলকে বাসের রুট জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি। উত্তরের বদলে ওই পুলিশকর্মী রীতিমতো ধমক দিয়েছিলেন বৃদ্ধকে।
এটা নেহাতই উদাহরণ মাত্র। ট্র্যাফিক কর্মীদের দিকে এমন অভিযোগ মাঝেমধ্যেই ওঠে। অনেকেই বলেন, পথঘাটে কারণ-অকারণে অনেক পুলিশকর্মীই চিৎকার করেন, রূঢ় ব্যবহার করেন। কখনও কখনও বাস বা ট্যাক্সি চালকদের সঙ্গে এ নিয়ে বচসাও বেধে যায় পুলিশকর্মীদের।
চিকিৎসকেরা বলছেন, এই মেজাজ হারানোর পিছনে রয়েছে কাজের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপ। শরীর ও মনের উপরে সেই চাপই কখনও কখনও ব্যবহারে ঠিকরে বেরিয়ে আসে। ট্র্যাফিক পুলিশের যা কাজ, তাতে শরীর ও মনে চাপ পড়াটাই স্বাভাবিক। একে তো রোদ-জল উপেক্ষা করে ডিউটি, তার উপরে ক্রমাগত গাড়ির ধোঁয়া এবং হর্নের শব্দ। সব মিলিয়ে টানা ডিউটি করতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক।
সেই অসুস্থতার ছবি বদলাতে এ বার নয়া পন্থা নিয়েছেন লালবাজারের কর্তারা। শুক্রবারই একটি নির্দেশিকা জারি করে ট্র্যাফিক পুলিশের ডিউটির সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সাপ্তাহিক ছুটি। পুলিশকর্তারা বলছেন, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ছুটি পেলে শারীরিক ও মানসিক ভাবে চাঙ্গা থাকবেন কর্মী-অফিসারেরা। তার সুফল পাবেন আমজনতাও। কারণ, পুলিশ সরকারের মুখ। আর ট্র্যাফিক হল পুলিশের মুখ। লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘সেই কারণেই প্রথমে ট্র্যাফিক কর্মীদের ডিউটি শোধরাতে বলেছিলেন পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার।’’
পুলিশ জানায়, শুক্রবার দুপুরে কলকাতার ডিসি (ট্র্যাফিক-দক্ষিণ) কল্যাণ মুখোপাধ্যায় প্রথমে নির্দেশিকা জারি করেন। পরে তা সার্বিক ভাবে শহরের সব ট্র্যাফিক গার্ডকে জানানো হয়েছে। ঠিকমতো ডিউটি রোস্টার তৈরি হচ্ছে কি না, তা নজর রাখবেন ট্র্যাফিকের সহকারী কমিশনারেরা।
২০০৯ সালে ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষায় উঠে এসেছিল, কলকাতা পুলিশের কর্মীরা হা-ক্লান্ত। ওই বছরেই পুজোর আগে শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসি-র মৃত্যুর পরেও কাজের চাপ নিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন অনেকে। পরবর্তী কালে পুলিশকর্মীদের স্বাস্থ্যরক্ষায় নানা পদক্ষেপ করেছিলেন লালবাজারের কর্তারা। দূষণ, রোদের হাত থেকে বাঁচতে ট্র্যাফিক পুলিশকে মাস্ক, ছাতা, গ্লুকোজ দিতে শুরু করেন তৎকালীন লালবাজারের শীর্ষকর্তারা। কিন্তু ডিউটি বদলের কথা ভাবা হয়নি। কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের বিশ্রামের জন্য স্ট্যান্ড তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে সব দিকে নজর রাখা সম্ভব হয় না।
নতুন নির্দেশিকা শোনার পরে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘এটা দরকার ছিল। শুধু ট্র্যাফিক পুলিশ নয়, সব বিভাগেরই পর্যাপ্ত ছুটি ও বিশ্রাম প্রয়োজন। বিদেশে তো পুলিশ ৮ ঘণ্টাই ডিউটি করে।’’ পুলিশের কাজের চাপ মেনে নিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। পুজোর সময়ে অতিরিক্ত ডিউটি করায় পরে ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে ছুটিও দিয়েছেন তিনি।
ট্র্যাফিক কর্মীদের এই শারীরিক সমস্যার কথা টের পেয়েছেন ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং কলকাতা পুলিশের হাসপাতালের কনসালট্যান্ট চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটক। তিনি জানান, গত এক বছরে তাঁর কাছে অন্তত ৬০০ জন ট্র্যাফিক পুলিশকর্মী কোমর, হাঁটু বা ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে এসেছেন। শহরের বাতাসে দূষণের মাত্রা বেশি। তার ফলে ট্র্যাফিক পুলিশের কর্মীদের মধ্যে হাঁপানি, শ্বাসনালির রোগও বাড়ছে। মৌলিমাধববাবু বলছেন, টানা দাঁড়িয়ে থাকার ফলে শরীরের ওজন হাঁটুর উপরে পড়ে। ফলে হাঁটুর তরুণাস্থি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ পুষ্পকেতু কোনার বলছেন, ‘‘টানা দাঁড়িয়ে ডিউটি করতে হলে হাঁটু, কোমর, গোড়ালিতে ব্যথা হতে পারে। পায়ের শিরাতেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। তার প্রভাব কাজে পড়বেই।’’
ট্র্যাফিকের কাজে প্রতিবর্তক্রিয়া বেশি থাকতে হয়। কিন্তু টানা সেই কাজ করলে স্নায়ুর উপরে চাপ প়ড়ে। তার উপরে শব্দের উপদ্রবও স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। চিকিৎসকদের অনেকেরই মন্তব্য, এই স্নায়ুর চাপ কাজের ক্ষতি তো করেই, সঙ্গে পুলিশকর্মীদের উপরি পাওনা হয় অবসাদ, খিটখিটে মেজাজ। প্রতিবর্তক্রিয়ায় ঘাটতি হলে দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের মতে, ছুটি পেলে পুলিশকর্মীরা মানসিক ভাবে চাঙ্গা হবে। চাপের মুখে কাজ করতে সেটা অনেকটাই সাহায্য করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy