আধুনিক বাংলা নাটকের ইতিহাসের আরম্ভকাল মনে করা হয় ১৭৯৫-৯৬ সালকে। দলের নাম ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’, অনূদিত হয়েছিল দু’টি নাটক, রিচার্ড পল জোডরেল-এর দ্য ডিসগাইজ় (বাংলায় কাল্পনিক সংবদল) এবং মলিয়ের-এর লাভ ইজ় দ্য বেস্ট ডক্টর। ১৭৯৫-এর ২৭ নভেম্বর কাল্পনিক সংবদল-এর প্রথম অঙ্ক অভিনীত হয়, পরের বছর ২১ মার্চ তিনটি অঙ্কই। ইংরেজিগন্ধী এক বাংলা অনুবাদে বাংলা থিয়েটারের পথ দেখান যিনি, তিনি বাঙালি বা ভারতীয় নন, এমনকি ইংরেজও নন। তাঁর বাস সুদূর রুশ দেশে, নাম গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেভ (১৭৪৯-১৮১৭) (ছবিতে ডান দিকে)।
লেবেদেভ ছিলেন পরিব্রাজক, ভাষাবিদ, অনুবাদক ও সঙ্গীতকার। তবে স্বশিক্ষিত বেহালাবাদক হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কূটনীতিবিদ আন্দ্রেই রাজ়ুমোভস্কির সঙ্গী হিসেবে সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ভিয়েনা পাড়ি জমান। ইউরোপের নানা দেশ ঘুরতে থাকেন, জমে ওঠে রোজগার। এক সময় পৌঁছন ইংল্যান্ডে। তত দিনে সঙ্গীতকার হিসেবে পরিচিত লেবেদেভ। সরকারি আমন্ত্রণ পেয়ে ১৭৮৫ সালে তাঁর মাদ্রাজে আগমন। দু’বছর পর আসেন কলকাতায়, ছিলেন দশ বছর। বাংলা, সংস্কৃত ও হিন্দি— তিনটি ভাষাই শেখেন। বেহালাশিল্পী হিসেবেও নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে, টিকিট কেটে অনুষ্ঠানে আসেন শ্রোতারা। তিনিই প্রথম পশ্চিমি বাদ্যযন্ত্রে ভারতীয় সুর বাজান। এর পরেই ভারতে ইউরোপীয় ঢঙে প্রসেনিয়াম নাটকের ভাবনা তাঁর মাথায় আসে। স্থানীয় বিদ্যোৎসাহীদের সঙ্গে মিলে কলকাতায় প্রথম থিয়েটার তৈরি করেন। প্রথম বার প্রসেনিয়াম মঞ্চে অভিনয় করেন বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, থিয়েটারে প্রবেশের অধিকার মেলে ভারতীয় দর্শকদের। নাটকের জন্য ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের কথা নিয়ে তাতে সুরারোপ করেন লেবেদেভ। সে সময় কলকাতায় দু’টি বিলিতি নাট্যমঞ্চ ছিল, ‘দি ক্যালকাটা থিয়েটার’ ও ‘দি নিউ প্লে হাউস’। শোনা যায়, লেবেদেভের জনপ্রিয়তায় ইংরেজরা ভয় পেয়েছিল। কিছু দিন পরেই তাঁর সেই তিনশো আসনবিশিষ্ট থিয়েটারে আকস্মিক ভাবে আগুন লেগে ছাই হয়ে যায় সব কিছু!
বাংলা নাটকের ইতিহাসের এই মাইলফলকের ঠিকানা ছিল তৎকালীন কলকাতার ২৫, ডোমতলা; বর্তমানে যা ৩৭, এজরা স্ট্রিট। ২০০৯ সালের ২৭ নভেম্বর কলকাতা পুরসভা এবং কলকাতায় রুশ কনসুলেট জেনারেলের সংস্কৃতি বিভাগের উদ্যোগে সেই স্থানে একটি ফলক স্থাপিত হয় (ছবিতে বাঁ দিকে)। প্রত্যেক বছর ওই তারিখে সেখানে উপস্থিত হন কলকাতার রুশচর্চার প্রাণকেন্দ্র গোর্কি সদনের আধিকারিকেরা। এ বছর পূর্ণ হচ্ছে প্রথম অভিনয়ের ২২৫ বছর। সেই উপলক্ষে ওই দিন ফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়, আলোচনা হয় লেবেদেভের কাজ প্রসঙ্গে। এ ছাড়াও গত তিন বছর ধরেই প্রত্যেক মাসে লেবেদেভের স্মরণে একটি করে নাটক মঞ্চস্থ করার আয়োজন করছে গোর্কি সদন। অতিমারির কারণে মার্চ মাস থেকে বন্ধ ছিল সেই উদ্যোগ, আবার তা শুরু হচ্ছে ডিসেম্বরে।