যন্ত্রণা: আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহত বাসুদেব বিশ্বাস। সোমবার। নিজস্ব চিত্র
ডান হাতের কব্জির তিনটি আঙুল ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় ঝুলছে। সারা শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। সোমবার সাতসকালে দমদমের বিধান কলোনি সংলগ্ন রেললাইনের ধারে বিস্ফোরণের জেরে চোখের সামনে তখন সব ঘোলাটে দেখছেন কাগজকুড়ানি বাসুদেব বিশ্বাস। সেই অবস্থায় স্থানীয় বাসিন্দাদের তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘‘আমাকে বাঁচান। আমার ছোট ছোট দু’টো মেয়ে আছে।’’ বাঁ হাত ছোটবেলায় ট্রেনে কাটা পড়েছিল। জখম ডান হাতের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাসুদেব বলেছিলেন, ‘‘ডান হাত চলে গেলেও ক্ষতি নেই। প্রয়োজনে ভিক্ষা করব। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে চলো। নইলে দুটো মেয়ে ভেসে যাবে!’’
স্থানীয় সূত্রে খবর, সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ ঝোপের ভিতরে বনস্পতির ড্রামের মধ্যে কৌটোর আকৃতির ধাতব বস্তু দেখে শাসনের সন্ডালিয়া গ্রামের বাসুদেব তার একটি তুলে নেন। এর পরে বনগাঁ শাখার ডাউন লাইনের ধারে সেটি রেখে পাথর দিয়ে ঠুকছিলেন তিনি। আচমকা বিকট শব্দে এলাকা কেঁপে ওঠে। ছিটকে পড়েন বছর আটত্রিশের বাসুদেব। ঘটনাস্থলের কাছেই বাড়ি নন্দ অধিকারীর। তিনি বলেন, ‘‘বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ভেবেছিলাম, গ্যাস সিলিন্ডার ফেটেছে। বাইরে গিয়ে দেখি, সকলে রেললাইনের দিকে ছুটছে।’’ মায়া অধিকারী নামে আর এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘স্নান সেরে পুজো করছিলাম। প্রথমে বিকট শব্দ। তার পরে চার দিক ধোঁয়ায় ভরে গেল।’’
ঘটনাস্থলে গিয়ে এলাকাবাসী দেখেন, দুটো হাত বুকের কাছে চেপে ধরে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন বাসুদেব। গৌতম নস্কর নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য পুরসভার দফতরে ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু পুরসভার তরফে বলা হয়, খালপাড় দিয়ে রেললাইনের কাছে গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রায় আধ ঘণ্টা ওই অবস্থায় ছটফট করতে থাকেন জখম বাসুদেব। আরপিএফ-কর্মী আলতাব হোসেন ঘটনাস্থলে পৌঁছলে তাঁর সাহায্যে ডাউন হাসনাবাদ লোকাল থামিয়ে ভেন্ডর কামরায় বাসুদেবকে তোলা হয়। গৌতমবাবু বলেন, ‘‘হাতের কাছে স্ট্রেচার ছিল না। গুরুতর জখম অবস্থায় রেললাইন বরাবর হাঁটতে থাকেন ওই ব্যক্তি। বটতলার কাছে ট্রেন দাঁড় করিয়ে আমরা সবাই মিলে ভেন্ডরের কামরায় তুলে দিই ওঁকে।’’ এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, যে পথ দিয়ে বাসুদেবকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখানে পাথরের উপরে রক্তের দাগ। এর পরে দমদম স্টেশন থেকে গাড়ি করে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয় বাসুদেবকে।
এই ড্রামের মধ্যেই রাখা ছিল বোমাটি। সোমবার। নিজস্ব চিত্র
রেললাইনের চার ফুটের মধ্যে বিস্ফোরণ হল। বম্ব স্কোয়াডের সাহায্যে ঝোপঝাড়ের যে অংশ থেকে দমদম থানা ও জিআরপি যৌথ অভিযান চালিয়ে ড্রামের মধ্যে প্রায় ২৯টি তাজা বোমা উদ্ধার করেছে, তার দূরত্বও বেশি নয়। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার প্রশ্নটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। একসঙ্গে এতগুলো তাজা বোমা কী উদ্দেশ্যে কে বা কারা জড়ো করেছিল, সেটাই রহস্য। স্থানীয় বাসিন্দা সঙ্গীতা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘যেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে, সন্ধ্যার পরে সেখানে মদ, জুয়া, সাট্টার আসর বসে। প্রচুর অচেনা মুখের আনাগোনা ঘটে। প্রশাসনকে অনেক বার বলা হয়েছে। কেউ কানে তুললে তো!’’
কৌটো-সহ হলুদ ড্রামটি পরিকল্পনা করেই ঝোপের ভিতরে রাখা হয়েছিল বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে নাশকতার উদ্দেশ্যে সেগুলি মজুত করা হয়েছিল কি না, সেই জল্পনা দানা বেঁধেছে। স্থানীয় কাউন্সিলর প্রবীর পাল বলেন, ‘‘রেললাইনের ধারে আইনশৃঙ্খলার যে অবনতি হচ্ছে, তা পুলিশ, জিআরপি-কে জানিয়েছিলাম। এখন যদি কাজ হয়।’’
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে খবর, বাসুদেবের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ডান হাত বাঁচানো যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান চিকিৎসকেরা। চোখের আঘাতও গুরুতর। এ দিন স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে স্ত্রী বাসন্তী বিশ্বাস বলেন, ‘‘যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন ওর বাঁ হাত ছিল না। ওই এক হাতেই সংসার সামলেছে। বড় মেয়ে চন্দনা সাত বছরের। ছোট মেয়ে বন্দনার বয়স তিন। ভাড়া বাড়ির সংসারে দুই মেয়েই বাসুদেবের চোখের মণি। হাসপাতালে শুয়েও ওদের কথাই জিজ্ঞেস করছে। যা হওয়ার হয়েছে। সুস্থ হলে ঠিক সংসার সামলে নেবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy