Advertisement
E-Paper

নেই সহায়ক ব্যবস্থা, ছোট হচ্ছে মহিলাদের কাজের দিগন্ত

মাতৃত্বকালীন ছুটির শেষ দিকে চিন্তায় পড়েছিলেন বেসরকারি সংস্থার চাকুরে দেবমিতা গুপ্ত। সন্তানকে কোথায় রেখে ফের কাজে যোগ দেবেন, তার উত্তর মিলছিল না কিছুতেই। অফিসে ক্রেশ নেই।

সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২১ ০৭:০২
দায়িত্ব: বাড়িতে দেখভালের কেউ নেই। তাই সুভাষগ্রাম থেকে প্রতিদিন মেয়েকে নিয়েই গড়িয়াহাটের দোকানে আসেন মা।

দায়িত্ব: বাড়িতে দেখভালের কেউ নেই। তাই সুভাষগ্রাম থেকে প্রতিদিন মেয়েকে নিয়েই গড়িয়াহাটের দোকানে আসেন মা। তার পরে দোকানের ওই একচিলতে জায়গায় বসেই চলে বিকিকিনি, মেয়ের অনলাইন ক্লাসও। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

মাতৃত্বকালীন ছুটির শেষ দিকে চিন্তায় পড়েছিলেন বেসরকারি সংস্থার চাকুরে দেবমিতা গুপ্ত। সন্তানকে কোথায় রেখে ফের কাজে যোগ দেবেন, তার উত্তর মিলছিল না কিছুতেই। অফিসে ক্রেশ নেই। আয়া রাত ১০টার পরে থাকতে রাজি নন। এ দিকে, দেবমিতার শিফট বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত। সেটা পাল্টানোর সুযোগ নেই। শেষমেশ কাজে যোগ দিলেও শিফট শেষ হওয়ার আগেই বেরিয়ে পড়তেন দেবমিতা। কারণ, আয়া চলে যাওয়ার আগে বাড়ি পৌঁছতে হবে। তবে এই ব্যবস্থা স্থায়ী হয়নি। চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।

দেবমিতা একা নন। চাকরি ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য আনুষঙ্গিক সহায়তার ব্যবস্থা এতই কম যে, সাংসারিক দায়িত্ব পালনের জন্য অনেকেই বাধ্য হন চাকরি ছেড়ে দিতে। কারও ক্ষেত্রে আবার চাকরিতে যথেষ্ট সময় দিতে না পারার অভিযোগে আটকে যায় পদোন্নতি। সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার অভাবের জের এসে পড়ে শহর এবং গ্রাম— দু’জায়গার মহিলাদের উপরেই। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার অধীন পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স স্টাডিতেও দেখা গিয়েছে, ২০০৪-’০৫ সালে যেখানে ৪২.৭ শতাংশ মহিলা কাজ করছেন বা কাজ করতে ইচ্ছুক বলে জানিয়েছিলেন, ২০১৭-’১৮ সালে সেই সংখ্যাটাই কমে দাঁড়িয়েছে ২৩.৩ শতাংশে। করোনা অতিমারির জেরে এই সংখ্যা বর্তমানে আরও কমেছে বলেই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।

প্রথাগত শিক্ষা এবং বৃত্তিমুখী প্রশিক্ষণের অভাবের কারণে গ্রামের মহিলাদের সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ কার্যত থাকে না। কায়িক শ্রমের মাধ্যমে উপার্জনই একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের কাছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প
গুরুত্বপূর্ণ। তবে কোথাও কোথাও ২০ দিনও কাজ মেলে না বলে অভিযোগ ওঠে প্রায়ই। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বহু দূরে কাজ দেওয়া, সন্তানদের দেখার লোকের অভাব, সংসার সামলানোর পরে কাজ করতে যাওয়া, পরিবহণের অপ্রতুলতা এবং নিরাপত্তার অভাবের মতো সমস্যাও। ‘পিপলস আর্কাইভ অব রুরাল ইন্ডিয়া’-র অনুবাদ সম্পাদক স্মিতা খাটোর জানাচ্ছেন, অনেক ক্ষেত্রেই বহু দূরে কাজ দেওয়ায় গ্রামের মহিলারা সেখানে পৌঁছতে পারছেন না। অচেনা জায়গায় নিরাপত্তারও অভাব বোধ করেন তাঁরা। তাই কাজ পেলেও অনেকে তা গ্রহণ করতে পারছেন না। সুযোগেরই যেখানে এত অভাব, সেখানে বাচ্চার দেখভাল, শৌচাগার, সুষ্ঠু পরিবহণ বা খাবার ও জলের ব্যবস্থার দাবি তোলার কথা ভাবতেও পারেন না মহিলারা। স্মিতা বলেন, ‘‘দেশের গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো গড়ার কাজ করে চলেছেন তাঁরা। অথচ তাঁদের জন্যই কোনও পরিকাঠামো নেই।’’

অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা, শহরবাসী মহিলাদের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতিটা আলাদা নয়। সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা আর্থিক দিক থেকে এগিয়ে থাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে সমস্যার কিছুটা সমাধানের সুযোগ থাকে অনেকের কাছে। সম্প্রতি পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং কাজের শর্তাবলী (কেন্দ্রীয়) বিধি, ২০২০-র মাধ্যমে সন্ধ্যা ৭টার পরের শিফটে মেয়েদের দিয়ে কাজ করানোর ক্ষেত্রে কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছিল। কাজের জায়গায় ক্রেশ থাকা, পরিবহণ এবং ক্যান্টিনের ব্যবস্থা তার মধ্যে অন্যতম। এই বিধি লোকসভা এবং রাজ্যসভায় পাশ হলেও এখনও প্রযোজ্য হয়নি। তবে প্রযোজ্য হওয়ার পরেও বাস্তবে সেটি কতটা প্রয়োগ করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্দিহান কর্মরতারা।

এর আগেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রকের তরফে বলা হয়েছিল, কোনও সংস্থায় ৫০ জনের বেশি কর্মী থাকলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে কর্মীদের ছ’বছরের কমবয়সি সন্তানের জন্য ক্রেশ রাখতে হবে। তার যাবতীয় খরচ সংস্থাকেই বহন করতে হবে। কোনও সংস্থায় যদি মোট কর্মী ৫০ জনের কম, কিন্তু মহিলা কর্মী ৩০ জনের বেশি হন, সে ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য। ২০১৮-এ মন্ত্রকের সামাজিক সুরক্ষা বিভাগ থেকে রাজ্যগুলিকে এর জন্য বিধি তৈরির নির্দেশও দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুই হয়নি।

অর্থনীতির গবেষক ও শিক্ষক সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাড়ির কাজ ও সন্তানপালন শুধু মহিলারাই করবেন, এই মনোভাবের জন্য অনেকে কাজের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ দিতে পারেন না। তাই খাতায়-কলমে যে নিয়ম রয়েছে, তা কার্যকর করার দাবি জানাতে তাঁরা দ্বিধা বোধ করেন। লিঙ্গের ভিত্তিতে অসম আচরণের ভয় পান। ঋতুকালীন ছুটির প্রসঙ্গেও কর্মরতাদের মধ্যে এই মনোভাব দেখা গিয়েছিল। ন্যায্যটুকু চাইতে গিয়ে যেটুকু পাচ্ছেন, সেটাও হারানোর ভয় থাকে।’’

‘‘মহিলারা কর্মরতা হলে তাঁদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় হয় পরিবারের জন্য। সন্তানদের শিক্ষা, পুষ্টির জন্য। তাঁদের আয়ের সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অধিকারের সাম্যের বিষয়টি
সরাসরি যুক্ত। কাজ না থাকলে পরবর্তী প্রজন্মকে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যাবেন কী ভাবে?’’— প্রশ্ন তুলছেন স্মিতা। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য সহায়ক পরিকাঠামোর দাবি তাই শুধু মহিলাদেরই নয়, সামাজিক ভাবেই তোলা উচিত।

Kolkata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy