Advertisement
১১ মে ২০২৪
Lakhimpur Kheri

Komagata Maru incident: ‘উপনিবেশেই ভারতের ভূমিপুত্রদের প্রবেশাধিকার থাকবে না?’

ঘটনা ও তার ক্ষমা স্বীকারের মধ্যবর্তী সময়টুকুতে অনেকগুলো দশমী গিয়েছে। তাতেও ১০৭ বছর আগের এক দশমীর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের ক্ষত পুরোপুরি মেটেনি।

 ১৯১৪ সালে কোমাগাতা মারু জাহাজে গুরদিৎ সিংহের (প্রথম সারিতে বাঁ দিকে) নেতৃত্বে শিখ যাত্রীরা।

১৯১৪ সালে কোমাগাতা মারু জাহাজে গুরদিৎ সিংহের (প্রথম সারিতে বাঁ দিকে) নেতৃত্বে শিখ যাত্রীরা। ছবি: ভ্যাঙ্কুভার পাবলিক লাইব্রেরি থেকে।

দেবাশিস ঘড়াই
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২১ ০৭:৩৭
Share: Save:

বজবজ থেকে ছ’সাত কিলোমিটার দূরে গুরদিৎ সিংহের নেতৃত্বে শিখ দলটির সঙ্গে বাংলার মুখ্যসচিব, সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী-সহ এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য স্যর উইলিয়াম ডিউকের মুখোমুখি দেখা হল। শুরু হল গুরদিৎ-ডিউকের কথোপকথন।

—‘আমরা কলকাতা যাচ্ছি।’

—‘কলকাতায় তোমাদের কী কাজ?’

—‘প্রথমে গুরুদ্বারায় সঙ্গের গ্রন্থসাহেব জমা রাখব। তার পরে আমাদের অভিযোগ জানানোর জন্য গভর্নরের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করব।’

—‘গভর্নর আমাকেই তোমাদের অভিযোগ শুনতে পাঠিয়েছিলেন।’

ঘটনাপ্রবাহ বলছে, ‘শাসক’ কথা রাখেনি। উল্টে গুরদিৎদের উপরে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হল। এইচ জনস্টনের বই ‘দ্য ভয়েজ অব দ্য কোমাগাতা মারু: দ্য শিখ চ্যালেঞ্জ টু কানাডা’স কালার বার’-এর বয়ান অনুযায়ী— সেই গুলিবর্ষণের ‘পরে সব শান্ত হয়ে গেল’। ‘কানাডিয়ান মিউজিয়াম ফর হিউম্যান রাইটস’-এর তথ্য জানাচ্ছে, ওই সংঘর্ষে মোট ২২ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। মৃতদের মধ্যে ১৬ জন যাত্রী ছিলেন।

বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দিনটা ছিল ১৩২১ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন (১৯১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর)। আগের দিনই দুর্গাপুজো শেষ হয়েছে। দশমীর পরে গঙ্গায় সবে নিরঞ্জন হয়েছে দুগ্গা মায়ের। আর এ দিকে রেললাইনের উপরে ফেলে রাখা রয়েছে শিখ-সহ সংঘর্ষে মৃতদের নিথর দেহ।

অথচ ১৯১৪ সালের এপ্রিল মাসে সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ী পাঞ্জাবি গুরদিতের নেতৃত্বে জাপানি জাহাজ কোমাগাতা মারুতে চেপে কানাডার উদ্দেশে পাড়ি দেওয়া ৩৭৬ জন ভারতীয় কোনও বিপ্লব করতে যাননি। গিয়েছিলেন রুটিরুজির সন্ধানে। মে মাসে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে কোমাগাতা মারু নোঙর করলেও সেখানকার অভিবাসন নীতির জন্য যাত্রীরা দেশে ঢুকতে পারেননি। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ করে ১৯১৪ সালের ২৯ মে ‘দ্য টাইমস’-এ প্রকাশিত চিঠিতে অ্যানি বেসান্ত প্রশ্ন তুললেন,— ‘উপনিবেশেই তার (ভারত) ভূমিপুত্রদের প্রবেশাধিকার থাকবে না? এখন সে যদি সমস্ত উপ‌নিবেশের দরজা বন্ধ করে দেয়, তা হলে কি খুব দোষ দেওয়া যাবে?’ অন্য দিকে, ২১ মে ‘দ্য সান’ সংবাদপত্রে প্রথম পাতার শিরোনাম বেরোল— ‘হিন্দু ইনভেডারস নাউ অন্য দ্য সিটি হারবার অন কোমাগাতা মারু।’ কোনও সংবাদপত্রে আবার লেখা হল— ‘পাইরেটস’, জলদস্যু!

হাল না ছেড়ে গুরদিৎরা সেখানকার আদালতে মামলা লড়লেন। তবে হেরে গেলেন। দু’মাস পরে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা, ক্লান্ত, ক্ষুধা জর্জরিত যাত্রীদের নিয়ে কোমাগাতা মারু জাহাজ ভারতের উদ্দেশে রওনা দিল। অবশ্য এখানেও তাঁরা তখন ‘অবাঞ্ছিত অতিথি’। কারণ, এক বার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাওয়া ছিন্নমূলদের কবেই বা নিজস্ব ভূখণ্ড রয়েছে! যার ফল, বজবজে গুরদিৎদের উপরে পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং ‘বিনা প্ররোচনায় যাত্রীরাই প্রথমে গুলি চালিয়েছিল’ বিবৃতি জারি করে বঙ্গ সরকার ঘটনার দায় গুরদিৎদের উপরেই চাপিয়ে দিয়েছিল।

যেমনটা গত রবিবার উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলে আশিস মিশ্রের বিরুদ্ধে গাড়ির চাকায় কৃষকদের পিষে মারার অভিযোগ উঠলে প্রথমে যোগী আদিত্যনাথের সরকারের তরফে হিংসার দায় কৃষকদের উপরেই চাপিয়ে দেওয়া হয়। পরে দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ‘চাপে’ মন্ত্রীপুত্র আশিসকে গ্রেফতার করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সংযুক্ত কিসান মোর্চার সদস্য তথা কৃষক নেতা অরুণ রানা উত্তরপ্রদেশ থেকে ফোনে বললেন, ‘‘এতেই প্রমাণিত সরকার প্রথমে সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা বলেছিল।’’

এ দিকে গদর আন্দোলনের শতবর্ষ পূরণের এক বছর আগে, ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বজবজ স্টেশনের নাম পাল্টে রাখে ‘কোমাগাতা মারু বজবজ স্টেশন’। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দরের (কলকাতা বন্দর) হেরিটেজ পরামর্শদাতা গৌতম চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, ১৯৫২ সালে বজবজে বন্দরের জায়গায় ওই ঘটনার স্মৃতিবিজড়িত শহিদ বেদীর উদ্ঘাটন করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘কিছু দিন আগে বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে বজবজে বন্দরের ওই জায়গাতেই, অর্থাৎ, শহিদ বেদীর একই কম্পাউন্ডেই কোমাগাতা মারু ঘটনার স্মৃতিতে একটি সংগ্রহশালার নির্মাণও সম্পূর্ণ হয়েছে। সেটি উদ্ঘাটনের অপেক্ষায় রয়েছে।’’

) বজবজে বন্দরের জায়গায় উদ্ঘাটনের অপেক্ষায় কোমাগাতা মারু সংগ্রহশালা।

) বজবজে বন্দরের জায়গায় উদ্ঘাটনের অপেক্ষায় কোমাগাতা মারু সংগ্রহশালা। নিজস্ব চিত্র।

কোমাগাতা মারু ঘটনার ১০২ বছর পরে, ২০১৬ সালের ১৮ মে হাউজে দাঁড়িয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ক্ষমা চেয়ে বলেন— ‘‘তাঁরা (কোমাগাতা মারুর যাত্রীরা) যে যন্ত্রণা-দুর্দশার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন তার জন্য কোনও শব্দই যথেষ্ট নয়।’’ ঘটনা ও তার ক্ষমা স্বীকারের মধ্যবর্তী সময়টুকুতে অনেকগুলো দশমী গিয়েছে। তাতেও ১০৭ বছর আগের এক দশমীর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের ক্ষত পুরোপুরি মেটেনি।

আজ, সোমবার মহাষষ্ঠী। অর্থাৎ ‘আনুষ্ঠানিক ভাবে’ দুর্গাপুজোর শুরু। আর ‘বলো দুগ্গা মাঈ কী জয়’-এর হর্ষধ্বনির মাধ্যমে দশভুজার আবাহন এবং দশমীর ভাসান— সময়ের এই দুই বিন্দুকে ছুঁয়ে রয়েছে বিপন্নতায় ভোগা রুটিরুজির সন্ধানে বিদেশ-বিভুঁইয়ে যাওয়া এবং সেখানে প্রত্যাখাত হয়ে দেশে ফিরে এসে শাসকের গুলিতে নিহত একদল মানুষের বিষাদ-আখ্যান!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lakhimpur Kheri History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE