নববর্ষের সেই চেনা ছবি। ফাইল চিত্র
পয়লা বৈশাখ মানেই নতুন বছরে হিসেবের খাতা খোলা। ভোটের মরসুমেও তা পরোক্ষ ভাবে সত্যি। যদিও এর জন্য পয়লা বৈশাখের পরেও অপেক্ষা করতে হবে বেশ কয়েকটা দিন। ভোটের বাক্স খোলার পরেই বোঝা যাবে এ বারে কার খাতা খুলল! ১৪২৬ বঙ্গাব্দে তাই এ বার নববর্ষের সঙ্গে ‘ভোট-যুদ্ধ’ মিশে চেনা শহরই হয়ে উঠবে ‘অন্য শহর’।
বাঙালি তো বটেই, ছোট থেকে বড় ব্যবসায়ী সকলের কাছেই বৈশাখের প্রথম প্রভাত হয় একটু অন্য রকম। ভোর রাতে কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, তারাপীঠ থেকে পাড়ার কালী মন্দিরে হাজির হয়ে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা খাতায় পুজোর প্রসাদী ফুল ঠেকিয়ে ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি কামনা করবেন অনেক ব্যবসায়ীই। প্রতি বছরের চেনা সেই ছবিতে এ বার ভাগ বসাবেন অনেক ‘দাদা-দিদি’ও।
লোকসভায় পাঁচ বছরের খাতা খোলার আশীর্বাদ নিতে সকাল-সকাল তাঁরাও হাজির হবেন মন্দিরে। যেমন কলকাতা দক্ষিণ কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মালা রায় নববর্ষের ভোরে যাবেন কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিতে। আর কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র বিগত ৪০ বছরের ধারা বজায় রেখে এ বারেও পৌঁছে যাবেন দক্ষিণেশ্বরে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
বাংলা নববর্ষ মানেই শহর থেকে শহরতলির বদলে যাওয়া দোকানের ছবি। আচমকাই কোনও এক দিন সকালে যা সেজে ওঠে নতুন রঙের প্রলেপে। দোকানের দরজার দু’পাশে মঙ্গল ঘট-কলাগাছের সঙ্গে থাকে সিঁদুরের ছাপ দেওয়া লাল খেরোর খাতা। নতুন বঙ্গাব্দে দিল্লি দখলের লড়াইয়েও যেন তেমনই সেজে ওঠার ছোঁয়া। তিলোত্তমা কলকাতার শ্যাওলা ধরা ইট বেরনো পাঁচিল থেকে নতুন বাড়ির দেওয়ালও এখন নানা রঙের আঁকিবুঁকিতে অন্য রূপে। দোকানের দরজায় ঝোলানো শোলার কদম ফুলের মতোই গলি থেকে রাস্তা ছেয়েছে বিভিন্ন দলের পতাকা, ফেস্টুনে। যা দেখে রসিক শহরবাসী বলছেন, ‘‘বর্ষবরণের মতো ভোটও তো উৎসব। তাতে কোনও এক জনকে বরণ করে নেওয়ার পালা।’’
তবে পয়লা বৈশাখ যতই হোক পাওনাদারির পার্বণ। এমন ভদ্র কায়দায় দেনাপাওনা মিটিয়ে নেওয়ার মধ্যেই তো ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে গড়ে ওঠে সুসম্পর্ক। ভোট প্রচারও তো সেই চিরাচরিত প্রথার মতোই। তাই নববর্ষ পালনের সুযোগে বিরোধী ভোটারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরিতে মরিয়া সব রাজনৈতিক দল। যেমন, কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায়। তাঁর নামে নববর্ষের শুভেচ্ছা বার্তার কার্ড পৌঁছোচ্ছে ভোটারের কাছে। ‘মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা’র মতো শুভ দিনক্ষণের হদিশ দিতে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেওয়া পঞ্জিকা ছাপিয়ে বিলি হচ্ছে লিলুয়ায়। আবার হাওড়ার তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি ও নাম দেওয়া বাংলা পকেট ক্যালেন্ডার পৌঁছে যাচ্ছে ভোটারদের হাতে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বৈশাখী আড্ডার রেওয়াজ পুরনো। আর ভোটের ময়দানে সেখানেই আড্ডার মেজাজে ভোটারদের কাছে প্রচার করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছেন না অনেক প্রার্থীই। নন্দিনীদেবী যেমন প্রচারের মধ্যেই সময় করে উপস্থিত হবেন এলাকার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। প্রবীণদের সঙ্গে বসে আলাপচারিতা করবেন মালাদেবীও।
এক সময়ে নববর্ষের প্রথম দিনেই হত কিছু বাংলা ছবির শুভ মহরৎ। মুক্তিও পেত অনেক ছবি। এ বারের ভোটের বাজারে অবশ্য সেই দিনটি সাধারণ মানুষের সঙ্গেই কাটাতে চাইছেন অভিনেত্রী এবং বসিরহাটের তৃণমূল প্রার্থী নুসরত জাহান। বলছেন, ‘‘নতুন বছর, নতুন আশা নিয়েই মানুষের সঙ্গে সময় কাটিয়ে শুরু করব।’’ আর ভোটের আবহে বর্ষবরণের প্রভাতফেরি অবশ্য এ বার বদলেছে প্রচার র্যালিতে।
আর বাকি ভূরিভোজ। শহরের ইতিহাস বলছে, আগে বছরের প্রথম রাতে নতুন পোশাকে সেজে অতিথিরা নিমন্ত্রণরক্ষায় যেতেন। তাঁদের জন্যে পাত পেড়ে ভূরিভোজের আয়োজন করতেন ব্যবসায়ীরা। কবি ঈশ্বর গুপ্তও তাঁর সংবাদ প্রভাকর কার্যালয়ে এই দিনে সাহিত্যসভার আয়োজন করে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রাখতেন। এখন অবশ্য ততটা না হলেও বাড়িতে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়াদাওয়া করতেই অভ্যস্ত বাঙালি। এ বারে সেই রীতিতে ছেদ না পড়লেও বৈশাখের দাবদাহে শরীর চাঙ্গা রাখতে মেনুতে কাটছাঁট করছেন অনেক প্রার্থীই। তবে ব্যতিক্রম মেদিনীপুর লোকসভার বিজেপি প্রার্থী দিলীপ ঘোষ। মেনুতে কাটছাঁট তো নয়ই, উল্টে জমিয়ে বাঙালি খাবার খাবেন বলে জানাচ্ছেন তিনি।
কালের পরিবর্তনে অবশ্য বদলেছে আপ্যায়নের রীতিও— মিষ্টির প্যাকেট আর বাংলা ক্যালেন্ডার উপহারে, যা নিতে দোকানে-দোকানে ভিড় মনে করাবে ভোটকেন্দ্রের বাইরের লম্বা লাইনকে। তবে কি এ বার হালখাতা করতে যাবেন, না কি প্রার্থীর সঙ্গে প্রচারে পা মেলাবেন? সব রাজনৈতিক দলেরই কর্মী-সমর্থকেরা বলছেন, ‘‘সবটাই করতে হবে। হালখাতা করতে যাওয়া মানে তো জনসংযোগ বাড়ানো।’’ শহরের মতো জেলাতেও সে কথাটা মাথায় রেখে বাজারে দোকানে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে বেরোবেন বাঁকুড়ার তৃণমূল প্রার্থী তথা বর্ষীয়াণ নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়। আর আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে দিন কাটাতে কেশিয়ারি পাড়ি দেবেন মেদিনীপুরের তৃণমূল প্রার্থী মানস ভুঁইয়া।
তবে ভোট বড় বালাই। তাই নববর্ষের দিনে প্রচারে বেরিয়েও নাগরিকদের সমস্যা দূর করার পথ বাতলাবেন প্রার্থীরা। যেমনটা এক সময় করতেন পুরোহিতেরা। বছরের প্রথম দিনে তাঁরা নতুন পঞ্জিকা পাঠ করে শোনাতেন বাড়ির মেয়েদের। অশুভ কিছু থাকলে তা কাটানোর বিধান দিতেন।
যদিও নতুন বঙ্গাব্দে ভোটের ‘শুভ-অশুভ’ জানা যাবে ৮ই জ্যৈষ্ঠ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy