Advertisement
E-Paper

#মিটু প্রতিবাদ কি শুধুই এলিটদের, কী বলছে কলকাতা?

অনেক মানুষের ‘কীর্তি’ই বেআব্রু করে দিয়েছে #মিটু। সব মিলিয়ে একটা আন্দোলনের চেহারা নিয়েছে।

রোশনি কুহু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৮ ১৫:৫৭
#মিটু আন্দোলনের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র।

#মিটু আন্দোলনের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র।

বেশ কিছু দিন ধরে একটা শব্দ দেশ জুড়ে একেবারে হইচই ফেলে দিয়েছে। সেই শব্দের ঝড়ে ওলটপালট হয়ে গিয়েছে অনেক কিছু। বেশ কিছু ‘নামী’ ব্যক্তি সম্পর্কে বদলে গিয়েছে জনসাধারণের ধ্যানধারণাও। সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় সেই শব্দবন্ধটি হল ‘#মিটু’

এ শব্দের অন্তর্নিহিত অভিঘাত গোটা বিশ্বের পাশাপাশি টের পেয়েছে ভারতও। অনেক মানুষের ‘কীর্তি’ই বেআব্রু করে দিয়েছে #মিটু। সব মিলিয়ে একটা আন্দোলনের চেহারা নিয়েছে। ‘মেলটওয়াটার অ্যানালিসিস’ নামে এক ডেটা অ্যানালিটিক সংস্থা বিশ্বব্যাপী একটা সমীক্ষা করে। তাতে দেখা যায়, চলতি বছরের অক্টোবরে #মিটু আন্দোলন নিয়ে সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছেন ভারতীয় নারীরা।

আরও পড়ুন: #মিটু আন্দোলনে কি এ বার ভাটার টান! মুখ খুললেন পামেলা অ্যান্ডারসন

আন্দোলনটা প্রকৃত অর্থে হলিউড থেকে শুরু হয়েছিল গত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের অক্টোবরে। ওই গবেষণা সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, এই আন্দোলন নিয়ে গোটা বিশ্বে যা আলোচনা হয়েছে তার ২৫ শতাংশ শুধু গত মাসেই ভারত করেছে। প্রায় ২৮ হাজার ৯৯০ বার ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে এই আন্দোলনের উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সব থেকে বেশি আলোচনা হয়েছে অক্টোবরের ১০ থেকে ১৮ তারিখের মধ্যে। হিসাব বলছে, #মিটু শব্দটা এ দেশ থেকে ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় ৪৯ হাজার বার! আর ‘যৌন নির্যাতন’ এবং ‘যৌন হেনস্থা’ শব্দ দুটো ওই মাসেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায় ২ হাজার ৯২৭ হাজার বার ব্যবহার করেছেন ভারতীয়রা।

সমীক্ষার এই হিসাব থেকেই একটা প্রশ্ন রীতিমতো গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আসছে— এই যে এত শত সহস্র বার উচ্চারিত হল #মিটু, তার মধ্যে প্রান্তিক নারীদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল তো! নাকি গোটাটাই এলিট শ্রেণির প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়াল?

(ইতিহাসের পাতায় আজকের তারিখ, দেখতে ক্লিক করুন — ফিরে দেখা এই দিন।)

প্রশ্নটা শুনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পাঞ্চালী রায় বললেন, ‘‘এই সমীক্ষার হিসাব দেখে প্রথমেই যে প্রশ্নটা আসছে, তা হল ভারতীয় মেয়ে কারা? যাঁরা দলিত, যাঁরা সংখ্যালঘু, তারা কি ভারতের মেয়ে নন? কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, #মিটু আন্দোলন শুধুই এলিটদের। এই আন্দোলনকে স্বাগত। তবে বেঙ্গালুরু বস্ত্র কারখানার শ্রমিকদের অত্যাচার নিয়ে কম সরব হয়েছেন চার পাশের মানুষ। নির্ভয়া নিয়ে যতটা প্রতিবাদ হয়েছে, সেটা কিন্তু দলিত ধর্ষণ নিয়ে হয়নি!’’ তাঁর মতে, ভারতের প্রতিটি মেয়ের কাছে এই #মিটু আন্দোলন পৌঁছে গেল কি না তা জানা জরুরি। তবে, এই আন্দোলন যে সামাজিক সম্পর্কে থেকেও একটা ‘মুখ খোলার’ জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে সেটা মেনে নিয়েছেন পাঞ্চালী।

আরও পড়ুন: ভয় দেখিয়ে আর লাভ নেই

নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মী সোহিনী রায়ও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। প্রতিবাদ জানানো নারীরা অবশ্যই এই সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু, একটা বড় অংশ তো এর বাইরে থেকে গেলেন! তাঁর কথায়, ‘‘সমীক্ষা অনুযায়ী, ২৫ শতাংশ ভারতীয় মেয়ে অক্টোবর মাসের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সবচেয়ে বেশি #মিটু ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই শতাংশের হিসাব কিন্তু এটা প্রমাণ করে না যে, ভারতীয় মহিলামহলের বড় অংশ এ বিষয়ে কথা বলছে। এমনটা মোটেও নয়।’’

কলকাতায় গৃহ পরিচারিকাদের একটি সংগঠন রয়েছে। বিভা দাস, দীপা ঘোষ সেই সংগঠনের সদস্য। কথা বলে জানা গেল, ওঁদের এ রকম কোনও পরিস্থিতির শিকার হতে হয়নি। কিন্তু তাঁদের পরিচিত বেশ কয়েক জনের সঙ্গে এমনটা হয়েছে। কোথায় থাকেন তাঁরা? গড়পার রোড কিংবা পঞ্চাননতলার বস্তিতে। কয়েক বছর আগেও যৌন হেনস্থার কারণে কারও বাড়িতে কাজ ছাড়তে বাধ্য হলেও সেটা বলতে পারতেন না বাড়িতে। কেন? তাঁদের এক জন পুতুল সাহু বললেন, ‘‘জানালে স্বামীর হাতে মার খেতে হত। যেন আমারই দোষ! কিন্তু এখন এই সংগঠন থাকায় বলতে পারি যে, আমার সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে।’’

আর ঠিক এখানটাতেই সোহিনী রায়ের প্রশ্ন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার ক’জন জানেন বলুন তো?’’ এর পরেই তাঁর ব্যাখ্যা— দলিত, ঠিকাদার, সংখ্যালঘু, নিম্নবিত্তদের সোশ্যাল মিডিয়া নেই। পাশাপাশি তিনি বলছেন, ‘‘তবে এটাও ঠিক যে, উচ্চবিত্ত মেয়েরা শুধু মুখ খুলছেন তেমনটা মোটেও নয়।’’ এর সপক্ষে যুক্তিও দিচ্ছেন সোহিনী। তাঁর কথায়, ‘‘সাজিদ খানের বিরুদ্ধে যে জুনিয়র শিল্পী অভিযোগ এনেছেন, তিনি একেবারেই সামান্য পারিশ্রমিক পান। বা এক জন জুনিয়র সাংবাদিকের বেতনও একেবারেই কম বলেই জানি।’’ আর এখান থেকেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা উচ্চবিত্ত না-ও হতে পারেন।’’

সমাজকর্মী মিরাতুন নাহারের মতে, যৌন হেনস্থার ঘটনা এ দেশেই বেশি হয়। কারণ, যৌনতা নিয়ে বিদেশের তুলনায় এখানে ধারণাটা ভিন্ন। মিরাতুনের কথায়, ‘‘মেয়েরা দীর্ঘ কাল ভয় পেয়েছেন। ক্ষমতাকে ভয় পেতেন তাঁরা। তাই সরব হওয়াটা এখন চোখে পড়ছে।’’ তাঁর দাবি, যত বেশি অত্যাচার, তত বেশি রুখে দাঁড়ানো। তিনি একটি অভিজ্ঞতার কথা বললেন। কলকাতার একটি বিখ্যাত গবেষণা সংস্থার সঙ্গে তিনি যুক্ত। সেখানে একটি মেয়েকে বার বার বলা হয়েছে, যৌন হেনস্থার প্রতিবাদ জানালে তিনি ডক্টরেট পাবেন না। কিন্তু মেয়েটি রুখে দাঁড়িয়েছে। মিরাতুন বললেন, ‘‘যাঁরা মেয়েটিকে ভয় দেখিয়েছেন, তাঁরা বুঝতে পারেননি। এ ভাবে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছেন মেয়েরা। একেবারেই চুপ করে থাকার পর উঠে দাঁড়ানোটাই তাই বেশি করে চোখে পড়ছে।’’

আরও পড়ুন: #মিটু: কমিটির কাছে সাক্ষ্য বোর্ডকর্তাদের

ভারতে কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা বহু বছর হচ্ছে। কিন্তু বলার জায়গা ছিল না। এখন সেটা তৈরি হচ্ছে, তাই একটা অংশের মহিলারা মুখ খুলতে পারছেন। যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে জানেন, তাঁরা প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু, দরিদ্র ক্ষেতমজুর মহিলা এখনও সে সুযোগ পাচ্ছেন না। সমাজতত্ত্ববিদ প্রদীপ কুমার বসুর মতে, নারী আন্দোলন ও বামপন্থী আন্দোলনের সবথেকে বড় সীমাবদ্ধতা এটাই।

সমাজকর্মী-অধ্যাপিকা শাশ্বতী ঘোষ বললেন, ‘‘মেয়েদের মধ্যে একটা জিনিস তৈরি হচ্ছে। তাঁদের যত মারবে, তাঁরা ভাববেন তত এগোব। মেয়েরা বসে থাকবেন না।’’ তাঁর বক্তব্য, সোশ্যাল মিডিয়া কামদুনির মেয়েটিও হয়তো ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু তাঁর সেই নেটওয়ার্ক নেই। পল্লবী গগৈ করলে যে আলোড়ন হয়, তা তো এক জন সাধারণ মেয়ের জন্য হবে না। কিন্তু, এটা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে যে পেশাদার মেয়েরা মুখ খুলছেন।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

(শহরের প্রতি মুহূর্তের সেরা বাংলা খবর জানতে পড়ুন আমাদের কলকাতা বিভাগ।)

MeToo মিটু MeToo Controversy Sexual Harassment India Feminism Protest Gender Issues
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy