Advertisement
E-Paper

কম্পিউটার না কিনে আড়াই কোটি গুণাগার

শিশু-শিক্ষার একটি কম্পিউটারের জন্য তিন বছরে খরচ ২ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকা! আর এত টাকা খরচ করেও মাত্র হাজার বিশেক টাকা দামের ওই কম্পিউটারের মালিক হতে পারল না কলকাতা পুরসভা।

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:৫৩

শিশু-শিক্ষার একটি কম্পিউটারের জন্য তিন বছরে খরচ ২ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকা!

আর এত টাকা খরচ করেও মাত্র হাজার বিশেক টাকা দামের ওই কম্পিউটারের মালিক হতে পারল না কলকাতা পুরসভা।

বিচিত্র এই কাণ্ড ঘটেছে পুরসভার শিক্ষা দফতরে। গত তৃণমূল শাসিত পুরবোর্ডের আমলে। আর এ জন্য পুরসভার তহবিল থেকে ‘অকারণে’ গলে গিয়েছে বাড়তি প্রায় সওয়া দু’কোটি টাকা। আর তাতেই চোখ কপালে উঠেছে পুরসভার কর্তাদের একাংশের। এমনকী, ওই ঘটনায় হতভম্ব পুরসভার শিক্ষা দফতরের বর্তমান মেয়র পারিষদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ও। যদিও মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই।

পুরসভা সূত্রের খবর, পুর-স্কুলে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নিজেরা কম্পিউটার না কিনে তা ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পুরকর্তারা। কম্পিউটার পিছু ভাড়া ঠিক হয় বছরে ৮২ হাজার টাকা। রীতিমতো টেন্ডার ডেকে তিন বছরের জন্য শহরের একটি সংস্থার কাছ থেকে ওই ভাড়ায় একশোটি কম্পিউটার নেওয়া হয়েছিল। গত তিন বছর ধরে ওই অতি সাধারণ মানের প্রতিটি কম্পিউটারের জন্য বছরে ৮২ হাজার টাকা করে মোট ২ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকা দিয়েছে পুরসভা। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘তিন বছর ধরে একটি কম্পিউটারের ভাড়ার জন্য যে আড়াই লক্ষ টাকা খরচ করা হল, সেই কম্পিউটার বাজারে পাইকারি দামে কিনলে বিশ হাজারে পাওয়া যেত। তাতে কম্পিউটারটি পুরসভার নিজস্ব সম্পদ হত।’’ পুরসভার হিসেব বলছে, একশোটি কম্পিউটার ভাড়ার জন্য পুরসভার গত তিন বছরে খরচ হয়েছে আড়াই কোটিরও বেশি। নিজেরা কিনলে ১০০টি কম্পিউটারই বিশ লক্ষে হয়ে যেত বলে মত পুরকর্তাদের একাংশের।

স্বাভাবিক ভাবেই ত্রিফলা ও লেক মল কেলেঙ্কারির মতো কম্পিউটার ভাড়া নেওয়ার বিষয়টিতেও পুর-সম্পদ নয়-ছয়ের অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। পুরসভার বাম কাউন্সিলর চয়ন ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘নাগরিকদের করের টাকা এ ভাবে নয়-ছয় করার অধিকার পুরবোর্ডের নেই। এর তদন্ত দরকার।’’ কংগ্রেস কাউন্সিলর প্রকাশ উপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এটি চরম দুর্নীতি। জানি না বলে বিষয়টি এড়িয়ে গেলে চলবে না।’’ বিজেপি-র রাজ্য সম্পাদক রীতেশ তিওয়ারির মন্তব্য, ‘‘করের টাকায় ‘পাইয়ে দেওয়া’র রাজনীতি শুরু করেছে তৃণমূল।’’

২০১২ সালেই পুরসভার ত্রিফলা কেলেঙ্কারি নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। টেন্ডার এড়াতে ২৭ কোটি টাকার কাজকে পাঁচ লক্ষ টাকার নীচে ৫৪০টি ভাগে ভাগ করে পুর-প্রশাসন। তা নিয়ে উত্তাল হয় পুর-অধিবেশনও। এর পরে রাজ্য সরকারের ২৪ কোটি টাকা লোকসান করে লেক মলের চুক্তি ভাঙা নিয়েও অভিযোগ ওঠে তৃণমূল শাসিত পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে।

সূত্রের খবর, পুরসভা পরিচালিত স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়ার জন্য ২০১১ সালে কম্পিউটারগুলি ভাড়া নেওয়ার কথা হয়। প্রকল্পের পোশাকি নাম ‘কম্পিউটার এডেড লার্নিং’। সে বছরের সেপ্টেম্বরে মেয়র পারিষদের বৈঠকে বিষয়টি অনুমোদিতও হয়ে যায়। বলা হয়েছিল, স্কুলে ছোট বাচ্চাদের তার প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়ার ব্যাপারেও সহায়তা দেবে বরাতপ্রাপ্ত সংস্থা। পুরসভা সূত্রের খবর, সপ্তাহে দু’-তিন দিন এক ঘণ্টার জন্য পুরসভার কিছু স্কুলে পর্যায়ক্রমে শেখাতে যাবেন বরাত পাওয়া সংস্থার নিযুক্ত প্রতিনিধি।

কী শেখানো হত ওই প্রকল্পে?

তিলজলায় পুরসভা পরিচালিত স্কুলে কম্পিউটার শেখাতেন জুবের হোসেন নামে এক যুবক। তাঁর কথায়, ‘‘বাচ্চাদের অ-আ, ক-খ এবং গণিতের অক্ষর শেখানো হত ছবি দেখিয়ে।’’ তিলজলার ওই স্কুলে পুরসভার নিযুক্ত শিক্ষকও রয়েছেন। তাঁরাও ওই বর্ণ পরিচয় ও গণিতের সংখ্যা ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে পড়ুয়াদের শেখাতেন। তা হলে কম্পিউটারে আলাদা করে তা শেখানোর প্রয়োজন কতটুকু, প্রশ্ন উঠেছে পুরসভার অন্দরমহলেই। ওই শিক্ষকদের সামান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে কেন ওই কম্পিউটার চালানো শেখানো হল না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শিক্ষকদের অনেকে জানিয়েছেন, শিশু-শিক্ষার এই সামান্য কাজটি করতে তাঁদের প্রশিক্ষণেরও দরকার হতো না। জুবেরের কথায়, ‘‘আমি নিজে দু’টো স্কুলে যুক্ত ছিলাম। এর জন্য মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা দেওয়া হতো।’’ শিক্ষকদের অভিযোগ, চুক্তির মেয়াদ শেষ হতেই কম্পিউটার সেট স্কুলে নিয়ে আসা বন্ধ করে দেয় ঠিকাদার সংস্থাটি।

পুরসভা সূত্রের খবর, টেন্ডারের মাধ্যমে আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র-সহ কম্পিউটার পিছু ভাড়া চূড়ান্ত হয়েছিল মাসে ৬৮৬০ টাকা। শেখানোর জন্য স্কুল পিছু এক জন প্রতিনিধি দেওয়ার কথা হয়েছিল। এক পুর-আধিকারিক জানান, বাস্তবে এক জনকে দিয়ে একাধিক স্কুলে শেখানোর কাজ করা হতো। তাতে ঠিকাদারের সাশ্রয় হয়েছে। দু’টো স্কুলে পুরসভা থেকে প্রায় ১৪ হাজার টাকা ভাড়া পেয়েছে ঠিকাদার সংস্থা। আর যাঁকে কম্পিউটার শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি পেয়েছেন মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা।

২০১২ সালে পুরসভার মেয়র পারিষদ (শিক্ষা) ছিলেন শশী পাঁজা। তাঁর কথায়, ‘‘যত দূর মনে পড়ছে, কম্পিউটার তো স্কুলে রেখে দেওয়ার কথা ছিল। নিয়ে যাবে কেন?’’ তিনি জানান, এ ব্যাপারে পুরসভার বর্তমান মেয়র পারিষদ কিছু বলতে পারবেন।

বর্তমান মেয়র পারিষদ (শিক্ষা) অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় অবশ্য এই গোটা প্রক্রিয়াটিরই বিরুদ্ধে। তিন বছর পরে ওই সংস্থার এই কম্পিউটার ভাড়ার চুক্তি ফের অনুমোদনের আবেদন আনতেই বাদ সেধেছেন তিনি। রাজনীতিতে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্বস্ত সহচর অভিজিতবাবু বলেন, ‘‘প্রথমে আমি তো জানতামই না কম্পিউটারগুলি ভাড়ায় নেওয়া হয়েছে। ওঁরা সেট নিজেদের হেফাজতে নিতেই সব জানতে পারলাম।’’ দামের চেয়ে এত বেশি টাকা দিয়ে ভাড়া নেওয়া উচিত নয় বলে তিনি মনে করেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এর চেয়ে কম্পিউটার কিনে নেওয়াই ভাল ছিল। তাতে স্কুলের সম্পদও বাড়ত।’’

Municipality computer money Tiljala
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy