Advertisement
E-Paper

প্রসূতি-মৃত্যু কমাতে নয়া প্রযুক্তি সরকারি

ছোট্ট একটি বালিশ। আর তা দিয়েই বাজিমাত করেছেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকরো।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৬ ০১:০৪

ছোট্ট একটি বালিশ। আর তা দিয়েই বাজিমাত করেছেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকরো।

জটিল প্রসব বা ‘অবস্ট্রাকটিভ লেবার’-এ প্রসূতি-মৃত্যুর হার এক ধাক্কায় কমাতে পেরেছে আর জি কর। সেই মডেল অনুসরণ করেই এ বার গোটা রাজ্যে প্রসূতিদের মৃত্যু বা প্রসবকালীন শারীরিক সঙ্কটের ঘটনা কমাতে চাইছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। এ ক্ষেত্রে ছুঁতে চাইছে কেরল, মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্রের মতো রাজ্যের সাফল্য।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, জটিল প্রসবের প্রধান কারণ হল, প্রসবের সময়ে গর্ভস্থ শিশুর মাথা অনেকটা নীচে নেমে আসা। এতে প্রসূতির যোনিমুখ আটকে যায়। স্বাভাবিক প্রসব অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন ফরসেপ দিয়ে টেনে বা সাকশন পাম্পের মাধ্যমে শিশুকে বার করার চেষ্টা করা হলে শিশু ও মা দু’জনেরই স্বাস্থ্য বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রচুর রক্তপাতও হয়।

এমন সমস্যায় অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারও করা হয়। তখন পেটের কাটা অংশ দিয়ে শিশুকে বার করার জন্য চিকিৎসককে শিশুর মাথা ঠেলে উপরের দিকে ওঠাতে হয়, অথবা পা ধরে টেনে শিশুকে বার করতে হয়। এতেও প্রসূতির জরায়ুর নীচের দিকের অনেকটা অংশ কেটে রক্তপাত হয়। ক্ষত বিষিয়ে সেপসিসও হতে পারে। এ রাজ্যে প্রসূতি-মৃত্যুর অন্যতম কারণ এই সেপসিস।

এই রকম পরিস্থিতিতেই সহজ পদ্ধতিতে ‘ফিটাল পিলো’ নামে এক ধরনের রবারের বালিশ ব্যবহার করে জটিল প্রসব সহজ করে ফেলেছে আরজিকর। পদ্ধতিটি প্রথম শুরু করেছিলেন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের কয়েক জন চিকিৎসক-শিক্ষক। সেটা ছিল ২০১১-১২ সাল। কিন্তু সেখানে অল্পদিন সেটা চালানো যায়। কারণ, সেই চিকিৎসকেরা কিছু দিনের মধ্যে বদলি হয়ে আসেন কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে। ২০১৩ সাল থেকে আরজিকরের স্ত্রীরোগ বিভাগেই আবার সেই পদ্ধতির প্রয়োগ তাঁরা শুরু করেন।

যে চিকিৎসকেরা এই কাজ করছেন সেই সুব্রতলাল শীল, দেবদত্ত ঘোষ, সন্ন্যাসী বর্মণ, গৌরিশঙ্কর কামিল্যা, জয়দেব মুখোপাধ্যায়রা জানিয়েছেন, রবারের একটি বালিশের সঙ্গে একটি নল লাগানো থাকে। বালিশটা ভাজ করে খুব সহজে যোনিপথ দিয়ে জরায়ুর ভিতর প্রবেশ করানো যায়। তার পরে তার নল দিয়ে জল পাঠিয়ে বালিশটাকে ফুলিয়ে দিলে সেটি নিরাপদে গর্ভস্থ শিশুর মাথার তলায় হালকা চাপ দিয়ে মাথাটা তুলে দেয়। ফলে পেট কেটে সহজে নীচে নেমে যাওয়া শিশুকে বার করা যায়। মা ও শিশুর দেহে কোনও আঘাত লাগে না। মায়ের রক্তক্ষরণ হয় না, সেপসিসেরও আশঙ্কা থাকে না।

২০১৩ সালের পয়লা এপ্রিল থেকে ২০১৪-র ৩১ মার্চ পর্যন্ত আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে জটিল প্রসবের ১৪০টি কেসে এই ‘ফিটাল পিলো’ ব্যবহার করে যে সাফল্য মিলেছে, সেই রিপোর্ট চলতি বছরের মার্চ মাসে নামী আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব গাইনকোলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিকস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ১৪০টি কেসের প্রতিটিতে মা ও শিশু সম্পূর্ণ সুস্থ থেকেছে এবং প্রসূতির রক্তক্ষরণ খুবই কম হয়েছে।

আর জি করে এখনও বহু জটিল সিজার কেস এই পদ্ধতিতেই হচ্ছে। সেখানকার অন্যতম স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শ্যামল চক্রবর্তী জানান, ২০১৫ সালে ওই হাসপাতালে মোট ১১ হাজার সিজার কেস হয়েছিল। এর মধ্যে ৩০০টি জটিল কেস ছিল। তার মধ্যে ৭৩টি কেস এ ‘ফিটাল পিলো’ ব্যবহার করে ১০০ শতাংশ
সাফল্য মিলেছে। অথচ যে জটিল কেসগুলিতে ওই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়নি, তার ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রসূতির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, সেপসিস, জরায়ু শিথিল হয়ে যাওয়া, জরায়ুর শিরা-উপশিরা ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। অন্য দিকে, সদ্যোজাতের অবস্থার অবনতি ঘটায় তাদের ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’-এ রাখতে হয়েছে অনেক দিন।

আর জি করের নজির থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত সরকারি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই পদ্ধতি চালু করার প্রাথমিক কাজকর্ম শুরু করেছে প্রসূতি মৃত্যু আটকাতে গঠিত স্বাস্থ্য দফতরের ‘অবস্টেট্রিক মেন্টর গ্রুপ’-এ। গ্রুপের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এটি নিঃসন্দেহে ভাল পদ্ধতি। মেন্টর গ্রুপে এর সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আর জি কর হাসপাতালে বছরে ২১ হাজার থেকে ২৫ হাজারের মতো প্রসব হয়। এর অন্তত ১০ শতাংশ জটিল প্রসব। সেখানে যদি নতুন পদ্ধতিতে এতটা সাফল্য মেলে, তা হলে সেটাকে গুরুত্ব দিতেই হয়।’’

স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, ‘‘এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গে প্রসূতি-মৃত্যুর হার প্রতি লক্ষে ১৪৫ থেকে কমিয়ে ১১৭ করা গিয়েছে। কিন্তু প্রসবের সময়ে বা পরে এক জন প্রসূতির মৃত্যু হলে বা শারীরিক অবস্থার অবনতি হলেও লজ্জাজনক। তাই গত ১ জুন একটি নির্দেশ জারি করে স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে, যে সব প্রসবে প্রসূতি প্রায় মরতে বসেছিলেন, এ বার থেকে সে সব কেসেরও তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে হবে। এই অবস্থায় ফিটাল পিলো আমাদের অনেকটা সমস্যার সমাধান করতে পারে।’’

তামিলনাড়ু, গুজরাত, কেরলের মতো রাজ্য প্রতি লক্ষ শিশু জন্মে প্রসূতিমৃত্যুর হার একশোরও নীচে নামিয়ে এনেছে। মুখ্যমন্ত্রীও প্রসূতি মৃত্যু কমানোর উপরে আলাদা জোর দিচ্ছেন। সেই লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে নতুন নতুন পন্থা নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতেই হবে মেনে নিয়ে সদ্য
স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া শশী পাঁজাও বলেন, ‘‘যে কোনও সুপরিকল্পনাকেই আমরা স্বাগত জানাই।’’

maternal mortality
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy