Advertisement
E-Paper

এক বছর পরও ডেঙ্গির ভয় মৃতের পরিবারে, নির্বিকার প্রশাসন

গত বছর বর্ষার পরেই কলকাতা ও শহরতলির ডেঙ্গি পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নেয়। রাজ্যে ডেঙ্গিতে মারা যান অন্তত ৪৬ জন। সেই মৃত্যু-মিছিলের পরেও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরিস্থিতির মোকাবিলার পরিবর্তে প্রশাসন তথ্য চাপতেই বেশি আগ্রহী বলে অভিযোগ উঠেছিল।

নীলোৎপল বিশ্বাস ও মেহবুব কাদের চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৮ ০১:০৫
আক্ষেপ: অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মেয়ে পূর্ণিমা বিশ্বাসের মৃত্যুর কথা বলছেন মা মুন্না হালদার।

আক্ষেপ: অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মেয়ে পূর্ণিমা বিশ্বাসের মৃত্যুর কথা বলছেন মা মুন্না হালদার।

একতলা বাড়ির ছাদে উঠলেই সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রাজ্য প্রশাসনের সদর দফতর নবান্ন। দূরত্ব মেরেকেটে ২০০ মিটার। এই ছাদেই শীতের দুপুরে বা গরমের বিকেলে মায়ের সঙ্গে সময় কাটত বছর পাঁচেকের ঋতিকার। এই ছাদেই তাকে খাওয়াতে নিয়ে যেতেন মা রুনু দে। কথা না শুনলে নবান্ন দেখিয়ে বলা হত, ওই বাড়ি থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হবে। মুহূর্তে খাওয়া শেষ হয়ে যেত ছোট্ট মেয়েটির।

তবে গত অক্টোবরের পর থেকে আর ছাদে ওঠা হয়নি ঋতিকার। ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে অক্টোবরেই মৃত্যু হয় মা রুনুদেবীর। তার পর মেয়েকে আর ছাদে উঠতে দেন না বাবা গোপালবাবু। এখনও ডেঙ্গি-ভয় তাড়া করে বেড়ায় তাঁকে। গোপালবাবু বললেন, ‘‘পরিবারটাই তো শেষ হয়ে গেল! অনেক কষ্টে মেয়েটাকে বড় করছি। রাতে ঘুম থেকে হঠাৎ হঠাৎ উঠে দেখি, মেয়েকে মশা কামড়াচ্ছে না তো!’’ তাঁর দাবি, ‘‘নিজেরাই পাড়া পরিষ্কার করেছিলাম। দু’-এক দিন পুরসভার লোক এলেও পরে সব বন্ধ হয়ে যায়।’’ তাঁর আর্জি, প্রশাসন একটু সতর্ক হোক! এ ভাবে ক’টা পরিবার শেষ হলে সচেতন হবে সরকার?

গত বছর বর্ষার পরেই কলকাতা ও শহরতলির ডেঙ্গি পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নেয়। রাজ্যে ডেঙ্গিতে মারা যান অন্তত ৪৬ জন। সেই মৃত্যু-মিছিলের পরেও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরিস্থিতির মোকাবিলার পরিবর্তে প্রশাসন তথ্য চাপতেই বেশি আগ্রহী বলে অভিযোগ উঠেছিল। অনেক ক্ষেত্রেই বলা হয়েছিল, ডেঙ্গি নয়, মৃত্যুর কারণ অজানা জ্বর। যদিও সরকারি হাসপাতালের একাধিক ডেথ সার্টিফিকেটের বয়ান অনুযায়ী পরে সত্যিটা আর চাপা থাকেনি। রুনুদেবীর মৃত্যুকেও প্রথমে ডেঙ্গি নয় বলে চালানোর চেষ্টা হয়। যদিও হাওড়া জেলা হাসপাতালের সরকারি চিকিৎসকেরাই ডেথ সার্টিফিকেটে লিখে দেন, ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যু হয়েছে রুনুদেবীর। বছর ঘুরতে না ঘুরতে সেই হাওড়াতেই আরও এক ডেঙ্গির মৃত্যুতে প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি গত বছরের ঘটনা থেকে কোনও শিক্ষাই নেয়নি প্রশাসন?

পূর্ণিমা বিশ্বাস। নিজস্ব চিত্র।

গত বছর ডেঙ্গিতে অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে হারিয়েছিলেন তাঁর মা, টালিগঞ্জের বাসিন্দা মুন্না হালদার। তাঁর কথায়, ‘‘আমার মেয়ে যখন মারা যায়, তখন ও ন’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কয়েক দিন এলাকায় সাফাইয়ের কাজ হল। তার পরে যে কে সে-ই! কিছুতেই কিছু বদলাচ্ছে না!’’ গত অক্টোবরেই প্রবল জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন অন্তঃসত্ত্বা পূর্ণিমা বিশ্বাস। তিন দিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। দেগঙ্গার পরে এ শহরেও এক অন্তঃসত্ত্বার মৃত্যুতে শোরগোল পড়ে যায়। মুন্নাদেবীর স্বামী মারা গিয়েছেন আগেই। মেয়ের মৃত্যুর পরে ছেলে অমিত আর জামাই সোমনাথকে নিয়ে থাকেন তিনি। একচালা ঘরে রয়েছে মেয়ের একাধিক ছবি লাগানো একটি বোর্ড। সেটিকেই দেখিয়ে বললেন, ‘‘আপনজন মারা যাওয়ার পরেও যখন দেখি পরিস্থিতি বদলাল না, খুব রাগ হয়।’’

আরও পড়ুন: খাতা ঠিকঠাক দেখা হয়েছিল কি, প্রশ্ন পার্থের

যাদবপুরের বাসিন্দা অভিজিৎ মজুমদারেরও জীবন বদলে দিয়েছে এক আপনজনের মৃত্যু। গত বছর ডেঙ্গিতে মৃত্যু হয় অভিজিৎবাবুর ছেলে, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আবির্ভাবের। ছেলের শোকে এখন পুরনো বা়ড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে অভিজিৎবাবুদের। যাদবপুরের পল্লিশ্রীর বাড়ি ছেড়ে বিজয়গড়ের একটি ফ্ল্যাটে উঠেছেন তাঁরা। বললেন, ‘‘ডেঙ্গিতে এর মধ্যেই এক জন মারা গিয়েছেন শুনলাম। খুব ভয় হচ্ছে। প্রশাসনের কাছে একটাই আর্জি, একটু সতর্ক হোন।’’ একই আর্জি উল্টোডাঙার মিন্টু সাউয়েরও। একমাত্র মেয়েকে রেখে গত বছর ডেঙ্গিতে মারা যান তাঁর পুত্রবধূ পুনম। বললেন, ‘‘এলাকার যা অবস্থা, থাকার যোগ্য নয়। কাকে বলব? ওর মাকে বাঁচাতে পারিনি। নাতনিটার জন্য খুব ভয় হয়।’’

ডেঙ্গিতে গত বছর মৃত্যু হয়েছিল আবির্ভাব মজুমদারের। নিজস্ব চিত্র

ডেঙ্গিতেই মৃত্যু হয় মানিকতলার মুরারিপুকুরের বাসিন্দা রিয়া সাহার। মেধাবী ছাত্রী রিয়ার বাবা গৌরাঙ্গবাবু বলছেন, ‘‘কারও উপরেই রাগ নেই। আমাদের রাগে, প্রতিবাদে কারও কিচ্ছু আসে-যায় না। সকলেই বলবেন, ডেঙ্গি নয়, সব মৃত্যুই স্বাভাবিক।’’

রিয়াদের বাড়ি থেকে বেরোনোর পরেও কানে বাজছিল রিয়ার মায়ের কথা। বলছিলেন, ‘‘পারবে কেউ মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিতে?’’

Death Awareness Howrah Dengue
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy