Advertisement
E-Paper

অভিজিৎ বিশ্বসেরা, তাঁর গল্প শুনল আর এক অভিজিৎ

খবরটা প্রথম শোনার পরে কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকল অভিজিৎ। দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া কিশোরের চোখেমুখে বিস্ময়—‘‘নোবেল পেয়েছেন! সেটা তো খুব বড় পুরস্কার।

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৯ ০২:০৬
অনুুপ্রেরণা: মহানির্বাণ রোডের বাড়ির অদূরে এই বস্তি থেকেই দারিদ্র্য নিয়ে প্রাথমিক ধারণা গড়ে উঠেছিল অভিজিৎবাবুর। নিজস্ব চিত্র

অনুুপ্রেরণা: মহানির্বাণ রোডের বাড়ির অদূরে এই বস্তি থেকেই দারিদ্র্য নিয়ে প্রাথমিক ধারণা গড়ে উঠেছিল অভিজিৎবাবুর। নিজস্ব চিত্র

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আলো জ্বলে উঠেছে গলির মুখে। তখনও অবশ্য খেলা থামেনি। দক্ষিণ কলকাতার মহানির্বাণ রোডের যে বাড়িটায় এক সময়ে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়েরা থাকতেন, সেই বাড়ির সামনেই বল নিয়ে খেলছিল অভিজিৎ হালদার, অভিষেক পুরকাইতরা। অনতিদূরেই যে ১৬ নম্বর পণ্ডিতিয়া বস্তিতে তারা থাকে, সেখানকার বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন দেখেই প্রথম দারিদ্র্য কী, তা বুঝতে শিখেছিলেন ছোট্ট অভিজিৎ বিনায়ক। পুরস্কার ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরেই কথা প্রসঙ্গে যা বলেছেন তাঁর মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়।

খবরটা প্রথম শোনার পরে কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকল অভিজিৎ। দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া কিশোরের চোখেমুখে বিস্ময়—‘‘নোবেল পেয়েছেন! সেটা তো খুব বড় পুরস্কার। আমরা কখনও ওঁকে দেখিনি। কিন্তু ওই বাড়িতেই তো থাকতেন শুনেছি। পড়াশোনা করে নোবেল পেলেন!’’ পাশের বাড়ির কেউ ‘সেরার সেরা’ পুরস্কার পেলে যেমন হয়, চোখে-না-দেখা তাঁরই ‘নেমসেক’-এর কৃতিত্বে তখন অভিজিতের চোখেও সেই বিস্ময়ঘোর! তার বাবা পার্কিং ফি আদায়ের

কাজ করেন। অভিজিতের পাশে দাঁড়ানো তারই বন্ধু, অষ্টম শ্রেণির অভিষেক পুরকাইত বলল, ‘‘আমাদেরও ভাল করে পড়াশোনাটা করতে হবে, বুঝলি!’’

অভিষেক পুরকাইত এবং অভিজিৎ হালদার। নিজস্ব চিত্র

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পাওয়ার খবর সোমবার মহানির্বাণ রোডে যেন এক ঝলক খুশির হাওয়া বয়ে এনেছিল। বস্তির বড়রা যখন সে খবর শুনেছিলেন, তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছেন, ‘‘নোবেল-টোবেল জানি না। কিন্তু উনি যে খুব বড় কিছু হয়ে উঠবেন, এটা জানতাম।’’ যেন কিছুটা প্রত্যাশিতই ছিল এ সাফল্য!

গত ৫২ বছর ধরে ওই বস্তিতে থাকেন শিবু যাদব। তিনি বললেন, ‘‘ওই বাড়ির সকলেই তো শিক্ষিত। আগে এখানেই থাকতেন। কিন্তু খুব একটা বেরোতেন না। তবে ওঁর ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে অনেক সময়েই। ভাই আমাদের সঙ্গে খেলতেনও।’’ আর এক বস্তিবাসী বললেন, ‘‘পুরো পরিবার পড়াশোনা নিয়েই থাকত। সেই বাড়ির ছেলে এত বড় সম্মান পেয়েছেন জেনে খুব ভাল লাগছে।’’

এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আগে মহানির্বাণ রোডে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে ১৬ নম্বর বস্তিটা পুরোপুরি দেখা যেত। কারণ, আগে একটা মাঠ ছিল ওখানে। গত কয়েক বছর ধরে সেখানে একটি আবাসন তৈরি হচ্ছে। ফলে ওই বাড়ি থেকে আর সরাসরি বস্তিটা দেখা যায় না! অভিজিৎবাবুর মা নির্মলাদেবী জানিয়েছেন, কী ভাবে এই বস্তির দৈনন্দিন জীবন দেখেই দারিদ্র্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা গড়ে উঠেছিল তাঁর ছেলের। ভাবনার বীজ হয়তো বোনা হয়েছিল তখন থেকেই।

পাঁচ ফুট চওড়া, অপরিসর গলিতে পাশাপাশি সারিবদ্ধ ঘর। প্রায় সব ঘরেই এখন টিভি। ফ্রিজ। বাসিন্দাদের হাতে হাতে ঘুরছে স্মার্টফোন। বয়স্ক বাসিন্দারা বলছিলেন, এক সময়ে এখানে পুরোটাই কাঁচা রাস্তা ছিল। কয়েক বছর আগে তা পাকা হয়েছে। স্কুলের গণ্ডি পেরোন কত জন? সেই নিয়ে কথা বলতে কেউ বিশেষ উৎসাহী হননি। তবে ওই পাকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অভিজিৎ বলছিল, ‘‘এক সময়ে আমাদের পাড়ায় থাকতেন, এমন কেউ এত বড় পুরস্কার পেয়েছেন ভাবলে সত্যিই খুব আনন্দ হচ্ছে। বন্ধুদের বলতে পারব, জানিস উনি এক সময়ে আমাদের পাড়ার পাশেই থাকতেন!’’ পাশে দাঁড়ানো অভিষেক বলে উঠল, ‘‘আমিও সবাইকে বলব ওঁর কথা! বলব, হেলাফেলা করিস না আমাকে। উনি আমাদের বাড়ির পাশে থাকতেন!’’

দুই বন্ধু কখনও এই নোবেলজয়ীকে দেখেনি। সোমবারের আগে তাদের জগতে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলে কেউ ছিলেনও না। কিন্তু নোবেল প্রাপ্তির খবর এক ঝটকায় সমস্তটা পাল্টে দিয়েছে। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে বছর সতেরোর অভিজিৎ, বছর বারোর অভিষেকরা। ‘আমরাও ভাল করে পড়াশোনা করব।’—এই কথাটারই অনুরণন হচ্ছে বস্তির পাশেই মহানির্বাণ রোডের ছোট্ট গলিটায়।

Abhijit Vinayak Banerjee Nobel Prize
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy