আগে ছিল শুধু ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের কাজ। এখন সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘তালাচাবি’।
তালাচাবি-র অর্থ, প্রোমোটারের কাজ বন্ধ করে দেওয়া। তার জায়গায় বাড়ি তৈরি করছে সিন্ডিকেট। জমি, বাড়ির নকশা, নগদ টাকা— সবই প্রোমোটার ব্যবস্থা করে দেবেন। সিন্ডিকেটের যুবকের দল পায়ের উপরে পা তুলে বসে কাজ সমাধা করবে। তাতে টাকাও বেশি।
ঠিক যেমন বিভিন্ন এলাকায় ডানা ছড়াচ্ছে সিন্ডিকেট, তেমনই ধরন বদলাচ্ছে তাদের কাজের। ‘তালাচাবি’ তারই সাম্প্রতিকতম ধরন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চান, সিন্ডিকেট থাকুক। বেকার যুবকেরা ‘কিছু করে খাক’। তিনি এটাও বলেছেন যে, ‘‘দেখতে হবে যেন সিন্ডিকেটের নামে জুলুম না হয়।’’ কিন্তু তাঁর সেই নির্দেশের চেয়ে বাস্তবের ফারাকটা চোখে পড়ার মতো। সাম্প্রতিকতম এই ‘তালাচাবি’ ব্যবস্থাই বলে দিচ্ছে, জুলুম শুধু চলছেই না। বরং বেড়েছে।
আর এখানেই উঠে আসছে রাজনীতির কথা। উঠে আসছে রাজনৈতিক ‘দাদা’দের প্রশ্রয়ের কথা। রবিবারই ভোটের প্রচারে বেরিয়ে রাজারহাট-নিউ টাউনের তৃণমূল প্রার্থী সব্যসাচী দত্ত বলেছেন, ‘‘সিন্ডিকেট ছিল, আছে এবং থাকবে।’’ তাতেই প্রশ্রয়ের ছবি দেখতে পাচ্ছে রাজনৈতিক মহল। অভিযোগ, মমতার ‘প্রশ্রয়ে’ চলা সিন্ডিকেটকে সামনে দাঁড় করিয়েই চলছে জুলুমবাজি।
সব্যসাচীবাবু রাজারহাটের বর্তমান বিধায়ক। বিধায়ক হওয়ার বহু আগে থেকেই ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণের জাদুকাঠি তাঁরই হাতে ছিল বলে মনে করে পুলিশ ও প্রশাসন। ফলে, এত দিনের সিন্ডিকেট-রাজের পিছনে তাঁর মদত নিয়ে দ্বিমত নেই বলেই মনে করে রাজনৈতিক মহল। তবে শুধু তিনি একা নন। বিধাননগরের বিধায়ক সুজিত বসু থেকে শুরু করে শাসক দলের বহু নেতা-নেত্রীই এখন বিভিন্ন সিন্ডিকেট দলের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন বলে অভিযোগ। যার বিনিময়ে সেই সব সিন্ডিকেট থেকে কাঁচা টাকা ঢুকে আসছে রাজনীতির আঙিনায়।
তবে কি মমতা যা বলছেন, তা শুধু কথার কথা? কারণ, তাঁরই দলের নেতা-নেত্রীদের ছাতার নীচেই সিন্ডিকেটের জুলুমের বাড়বাড়ন্ত বলে অভিযোগ। তবে কি দলের নেত্রীকে এক রকম বুঝিয়ে কার্যত অন্য রকম ব্যবসা চলছে? নাকি পুরো বিষয়ে সম্পর্কে দলনেত্রীও ওয়াকিবহাল? কিন্তু জনগণের সামনে মুখরক্ষার খাতিরে জুলুম না করার কথা বলছেন?
বাস্তব চিত্র থেকে প্রকট হয়ে উঠছে জুলুমের ছবিটাই। কারণ, ‘তালাচাবি’তে প্রোমোটারের কাছ থেকেই জমি, নকশা এবং নগদ টাকা নিয়ে তুলনায় কম খরচে নির্মাণ করছেন সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। তাতে মোটা লাভ থাকছে সিন্ডিকেটের। পাশাপাশি, আগের মতো মাল সরবরাহের কাজ তো চলছেই। সল্টলেক এলাকায় গাড়ি পিছু যে বালির দাম ৮-১০ হাজার টাকা, নিউ টাউন-রাজারহাটে সেই একই বালির দাম ২২-২৫ হাজার। নির্মাণ শুরু হওয়ার খবর পেলেই বাইক নিয়ে হাজির হয়ে যাচ্ছেন যুবকের দল। হাতে বালা, কানে দুল। ‘দোর্দণ্ড প্রতাপে’ বলে আসছেন, ‘‘দাদাকে বলবেন, মালটা আমাদের কাছ থেকে নিতে।’’
অমোঘ নির্দেশ। না মানলে বন্ধ হবে নির্মাণ। রাস্তাঘাটে প্রোমোটারের কপালে চড়-থাপ্পড়ও জুটতে পারে। ফলে, মুখ বুজে সহ্য করে প্রোমোটার দ্বিগুণেরও বেশি দামে বালি, পাথর কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। সিন্ডিকেটের লাভ বেশি বালিতেই। মহাজনের থেকে বালি কেনার পরে প্রতি কিউবিক ফুটে ১০০০-১২০০ টাকা লাভ থাকে। পাথরের ক্ষেত্রে প্রতি কিউবিক ফুটে লাভ ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা। যদিও, পাথর বিক্রি হয় কম। এর ফলে নির্মাণের খরচও বেড়ে যাচ্ছে। তাতে অবশ্য প্রোমোটারের নিজের লোকসান হচ্ছে না। যাঁরা ফ্ল্যাট বানাচ্ছেন বা তৈরি ফ্ল্যাট কিনতে চাইছেন, গাঁটের কড়ি বেশি গুনতে হচ্ছে তাঁদেরই।
সিন্ডিকেটের কাজে কায়িক পরিশ্রম নেই। শুধু মহাজনের কাছ থেকে মাল নিয়ে প্রোমোটরের কাছে পৌঁছে দিলেই হাতে কাঁচা টাকা। সেই টাকায় বাইক, নেশা, দামি পোশাক-আশাক, মোবাইল— সবই চলে আসছে হাতের মুঠোয়। সঙ্গে রাজনৈতিক দাদা-দিদিদের ‘আশীর্বাদ’। এ ভাবে প্রোমোটারদের ভয় দেখিয়ে ধমকে, বেআইনি পথে তোলা টাকার অংশ পৌঁছে যাচ্ছে রাজনীতির আঙিনায়। ‘দাদা’কে তুষ্ট রাখলে পুলিশকেও আর ভয় নেই। ২৫-৩০ বছরের রক্তে একটা বেপরোয়া ভাব জেগে উঠছে।
ফলে প্রথাগত শিক্ষায় না ঢুকে এ ভাবে খুব সহজে কাঁচা টাকা রোজগারের লোভে ভিড় বাড়ছে সিন্ডিকেট দলে। অভিযোগ, এই জমানায় সিন্ডিকেটের দাপটও তাই উত্তরোত্তর বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এলাকা দখলের জন্য খেয়োখেয়িও। বাগুইআটিতে সঞ্জয় রায় ওরফে বুড়ো নামে এক যুবককে দিনের আলোয় ভরা বাজারে গুলি করে খুন করার ঘটনা যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ বলে জানাচ্ছে পুলিশ। বুড়ো নিজে সক্রিয় ভাবে সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন বলে পুলিশ সূত্রে খবর। আর বিরোধী গোষ্ঠীর হাতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে তদন্তে জানা গিয়েছে।
সিন্ডিকেটে যুবকদের ভিড় বাড়ায় বেড়ে যাচ্ছে এলাকাও। যা প্রথমে ছিল রাজারহাটের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা পরে ছড়িয়ে পড়ে বাগুইআটি, দমদম, বিমানবন্দর এলাকাতেও। অভিযোগ, এখন ওই সব এলাকার কোথাও কোনও নির্মাণই সিন্ডিকেটের অঙ্গুলি হেলন ছাড়া সম্ভব নয়। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ঢুকে পড়তে চাইছে সল্টলেকেও। গত ৪০ বছর ধরে সল্টলেকে বাড়ি তৈরি হয়েছে। ছোট-বড় আবাসন, বড় অফিসও হয়েছে। তবে সম্প্রতি করুণাময়ীর ঘটনার মতো আগে কখনও দেখেনি সল্টলেক। সেখানে একটি আবাসন সারাইয়ের কাজে নামা এক প্রোমোটরকে হুমকি দিয়ে কাজ বন্ধ করার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি থানা পর্যন্ত গড়িয়েছে। পুলিশ মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করেছে। এই ঘটনাকে সল্টলেকে সিন্ডিকেটের হাতেখড়ি হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। আশঙ্কা, আগামী দিনে সিন্ডিকেটের বাইক-বাহিনীর দাপট বাড়তে পারে আপাত শান্ত এই নগরীতেও।
অথচ শুরুতে এমনটা ছিল না। এই সিন্ডিকেট ব্যবসারও ইতিহাস রয়েছে। রাজারহাট এলাকায় হাজার হাজার বর্গফুট জমিতে যখন উপনগরী তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল, তখন জমিহারা প্রান্তিক কৃষক-মৎস্যজীবীদের কাছে বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে উঠে এসেছিল এই সিন্ডিকেট ব্যবসা। সেই জমিহারাদের নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের পথ বাতলে দিয়েছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা। সেই সূত্র ধরেই প্রথমে কয়েকশো সমবায় তৈরি করে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ শুরু করেন স্থানীয় যুবকেরা।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে বোঝা যায়, এই ব্যবসায় কাঁচা টাকা রয়েছে। ফলে, সে দিকে নজর ঘোরে রাজনীতির কারবারিদের। সিন্ডিকেটের উঠতি যুবকদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন ‘দাদা’রা। তাতে এক দিকে যেমন টাকার জোগান শুরু হয়, অন্য দিকে বিভিন্ন কাজে, বিশেষত ভোটেও এই যুবকদের ইচ্ছামতো কাজে লাগানোও শুরু হয়। অভিযোগ, বাম জমানায় যা-ও একটু রাশ ছিল, পরিবর্তনের জমানায় সিন্ডিকেটের উপরে সেই রাশ আলগা হতে বেশি সময় লাগেনি।
আর রাশ আলগা হতেই ব্যাঙের ছাতার মতোই ছড়িয়ে পড়ছে সিন্ডিকেটের ব্যবসা। এই ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তি বা তাঁর নিকট আত্মীয় সরাসরি ঢুকে পড়ছেন রাজনীতিতে। কেউ কাউন্সিলর হচ্ছেন, কেউ পঞ্চায়েত প্রধান। নেতা-নেত্রীদের মদতে কাঁচা টাকায় পুষ্ট হয়ে এক শ্রেণির যুবকের জীবনযাত্রা বদলে যাচ্ছে আমূল। কোথায় যাচ্ছে এত টাকা? ... (ক্রমশ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy