Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ষোলো হাজার মাইল দূরত্ব পেরিয়ে বরফ আসত এ শহরে

১৬ হাজার মাইল দূর থেকে এ শহরে বরফ পৌঁছনোর কথা সম্প্রতি উঠে এল একটি আলোচনাসভায়। যদুনাথ ভবন মিউজিয়াম ও রিসোর্স সেন্টারের ওই আলোচনায় কলকাতার ইতিহাসের এই দিকটি তুলে আনেন ন্যাশভিলের বেলমন্ট ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ক্রিস্টিন রজার্স।

ঐতিহ্য: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেইন-এ হ্রদ থেকে সাবেক পদ্ধতিতে বরফ কাটছেন বাসিন্দারা। ছবি: ক্রিস্টিন রজার্স

ঐতিহ্য: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেইন-এ হ্রদ থেকে সাবেক পদ্ধতিতে বরফ কাটছেন বাসিন্দারা। ছবি: ক্রিস্টিন রজার্স

সুনীতা কোলে
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৯ ০১:২৩
Share: Save:

গরমে আইসক্রিম খাচ্ছিলেন দুই ভাই। জায়গাটা বস্টন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরের এই শহরে শীতে বরফ পড়ে, গরম আরামদায়ক। হঠাৎ এক ভাই বললেন, ভাগ্যিস তাঁরা বস্টনে থাকেন! তাই তো আইসক্রিম খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। দক্ষিণের শহর নিউ অর্লিয়েন্সের বাসিন্দাদের এই সৌভাগ্য হয় না। এ কথা শুনেই এক ভাই ফ্রেডরিক টিউডরের মাথায় বরফ রফতানির ভাবনা আসে। বস্টন এবং নিউ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন হ্রদ থেকে বরফ তুলে অন্য জায়গায় পাঠানোর উপায় খুঁজতে থাকেন ফ্রেডরিক। প্রথমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে বরফ পাঠানোর চেষ্টা তেমন সফল হয়নি। কিন্তু দমে না গিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান ফ্রেডরিক। আর সেই চেষ্টারই ফসল হিসেবে ১৮৩৩ সালে বস্টন থেকে কলকাতায় পৌঁছল স্বচ্ছ, সরাসরি পানীয়ে দেওয়ার বরফ। এর আগে হুগলির চুঁচুড়া থেকে অপরিষ্কার এক রকম বরফ কলকাতায় আসত বটে, কিন্তু তা খাওয়া যেত না।

১৬ হাজার মাইল দূর থেকে এ শহরে বরফ পৌঁছনোর কথা সম্প্রতি উঠে এল একটি আলোচনাসভায়। যদুনাথ ভবন মিউজিয়াম ও রিসোর্স সেন্টারের ওই আলোচনায় কলকাতার ইতিহাসের এই দিকটি তুলে আনেন ন্যাশভিলের বেলমন্ট ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ক্রিস্টিন রজার্স। তিনি জানালেন, ঠান্ডা এবং বরফের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক একটি আকর্ষণ রয়েছে। গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলিতে তো বটেই, ঠান্ডার দেশগুলিতেও এই আগ্রহ কম নয়। সেই আগ্রহের উপরে ভরসা করেই বরফের ব্যবসায় সাফল্য খুঁজছিলেন ফ্রেডরিক। শেষমেষ ১৮৩৩ সালে সফল হন তিনি। ১০০ টন বরফ নিয়ে কলকাতায় পৌঁছয় ‘টাস্কানি’ নামে একটি জাহাজ। বস্টন থেকে রওনা দেওয়ার সময়ে অবশ্য জাহাজে বরফ ছিল ১৮০ টনের মতো। চার মাসের দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় গলে যায় প্রায় অর্ধেক বরফ। জাহাজের মধ্যে বিশেষ ঘর বানিয়ে সেখানে রাখা হয়েছিল বরফ। গলে যাওয়া আটকাতে সমান আকৃতির পাতের মতো করে কাটা বরফের টুকরো রাখা হয়েছিল একদম গায়ে গায়ে। আর বিশেষ ঘরটি তাপনিরোধক করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল কাঠের গুঁড়ো, খড় ও ট্যান।

কলকাতায় সেই বরফ পৌঁছনোর পরে তা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে যায় মানুষের মধ্যে। ব্রিটিশরা তো বটেই, বরফ ব্যবহার করতে থাকেন সাধারণ মানুষেরাও। জাহাজের বরফ শহরে ঠিক মতো মজুত করে রাখার জন্য তৈরি হয় ‘আইস হাউস’। ক্রিস্টিন জানাচ্ছেন, কয়েক বছর পরে এই ব্যবস্থা এতই পাকাপোক্ত হয়েছিল যে হিমালয় থেকে বরফ আনার চেয়ে বস্টন থেকে বরফ আনার খরচ কম পড়ত। একটা সময়ে বরফের দাম দাঁড়িয়েছিল সের প্রতি দু’আনা। কলকাতার মতো বম্বে এবং মাদ্রাজেও ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। তবে প্রায় পাঁচ দশক ধরে চলার পরে, ১৮৭৮ সাল নাগাদ এই ব্যবসার মৃত্যুঘণ্টা বেজে যায়। বরফকল তৈরি হতে থাকে এ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। জাহাজে করে বরফ আসা বন্ধ হয়ে যায় তিন-চার বছরের মধ্যেই।

বস্টনের বরফ শুধু ভারতেই আগ্রহ তৈরি করেনি। ক্রিস্টিন জানাচ্ছেন, ইউরোপেও তা বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল। এমনকি, মার্কিন লেখক হেনরি ডেভিড থোরোর লেখাতেও উল্লেখ রয়েছে এই ব্যবসার। ওয়াল্ডেন হ্রদের পাশে থাকার সময়ে তিনি বরফ সংগ্রহকারীদের দেখতে পেতেন। তিনি লেখেন, চার্লস্টন, নিউ অর্লিয়েন্স, মাদ্রাজ, বম্বে এবং কলকাতার ঘর্মাক্ত বাসিন্দারা তাঁর কুয়ো থেকে পান করে।

এই ইতিহাসের কোনও চিহ্ন এখন কলকাতায় না থাকলেও এই ব্যবসার স্মৃতি ধরে রেখেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেইন রাজ্যের একটি ছোট শহরের বাসিন্দারা। এখনও প্রতি বছর শীতে হ্রদ থেকে বরফ তুলে রাখেন তাঁরা। জুলাই মাসে সেই বরফ থেকেই তৈরি আইসক্রিম দিয়ে জমে ওঠে উৎসব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ice Boston Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE