কঠিন বর্জ্য পোড়ানো। আর তার জেরে ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে উঠছে কলকাতার বাতাস। সম্প্রতি একটি গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই তথ্য। ওই গবেষণাতেই স্পষ্ট হয়েছে— কলকাতার বাতাসে যে ধূলিকণা ভেসে বেড়াচ্ছে, তা কোন মাত্রা ছাড়ালে প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।
গবেষণার নেতৃত্বে থাকা বোস ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কলকাতার বাতাসে থাকা অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা— পিএম ২.৫-এর মাত্রা বিষাক্ত হিসাবে চিহ্নিত হয়, যখন প্রতি ঘনমিটারে তার ঘনত্ব ছাড়িয়ে যায় ৭০ মাইক্রোগ্রাম। গবেষকদের মতে, এই সীমাকে শহরের বাতাসের জন্য ‘বিষাক্ত মাত্রার মানদণ্ড’ হিসাবে ধরা উচিত।
পিএম ২.৫ হল এমন এক ধরনের ধূলিকণা, যার ব্যাস ২.৫ মাইক্রোমিটারের কম। ফলে, এই কণা সহজেই মানুষের শ্বাসনালি পেরিয়ে ফুসফুসে ঢুকে পড়ে। এর জেরে দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্ট, হৃদ্রোগ, এমনকি কোষের ভিতরে জারণজনিত ক্ষতি। শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও এই ধূলিকণার কাছে পরাস্ত হয়।
এই ক্ষতিকর প্রভাব বোঝাতে বিজ্ঞানীরা ‘অক্সিডেটিভ পোটেনশিয়াল’ নামে একটি ধারণা ব্যবহার করেন। সহজ ভাবে বললে, অক্সিডেটিভ পোটেনশিয়াল-এর অর্থ হল ধূলিকণার সেই ক্ষমতা, যার মাধ্যমে তা শরীরের ভিতরে গিয়ে কোষের ক্ষতি করে। এই ধূলিকণা শরীরে ঢুকে এমন কিছু ক্ষতিকর উপাদান তৈরি করে, যাকে বলা হয় ‘রিঅ্যাক্টিভ অক্সিজেন স্পিসিস’ (আরওএস)। যা শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। ফলে, কোষের ক্ষয় ও নানা অসুখ দেখা দিতে পারে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতি ঘনমিটারে ৭০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত এই ধূলিকণার বিষাক্ত মাত্রা তুলনামূলক ভাবে স্থিতিশীল থাকে। কিন্তু সেই সীমা এক বার পেরিয়ে গেলে বিষাক্ত মাত্রা দ্রুত বাড়ে— যা ১৩০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। এর পরে আবার কিছুটা স্তিমিত হয়।
তবে গবেষকদের মতে, পিএম ২.৫-এর বিষাক্ত মাত্রার সঙ্গে তার ঘনমাত্রার সম্পর্ক সরলরৈখিক নয়। গবেষণা দলের তরফে জানানো হয়েছে, ধূলিকণার পরিমাণ যত বাড়বে, বিষাক্ত মাত্রাও তত বাড়বে—এমন নয়। বরং, একটি নির্দিষ্ট সীমা ছাড়ানোর পরেই বিষক্রিয়ার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়।
বোস ইনস্টিটিউটের গবেষণায় উঠে এসেছে আরও একটি গুরুতর তথ্য। কলকাতার বাতাসে যে পিএম ২.৫ ধরা পড়ছে, তার অন্যতম প্রধান উৎস জৈব ও কঠিন বর্জ্য পোড়ানো। রাস্তার ধুলো, যানবাহনের ধোঁয়া, শিল্প-বর্জ্য প্রভৃতি উৎস অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এলেও, শহরের বিভিন্ন
প্রান্তে এখনও নিয়মিত ভাবে বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে। আর সেখান থেকে উৎপন্ন ধোঁয়াই বাতাসে সবচেয়ে বেশি বিষ ছড়াচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের উদ্যোগে শুরু হওয়া ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম’ (এনসিএপি)-এর আওতায় কলকাতা-সহ দেশের ১৩১টি শহরে ২০২৬ সালের মধ্যে ধূলিকণার পরিমাণ ৪০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। কলকাতায় এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বোস ইনস্টিটিউটকে, যাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক ‘নোডাল ইনস্টিটিউট’ হিসাবে মনোনীত করেছে।
গবেষণাটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট’-এ প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণার ভিত্তিতে কলকাতা পুরসভা ইতিমধ্যেই জৈব বর্জ্য পোড়ানোর বিরুদ্ধে কড়া নজরদারি শুরু করেছে। যার প্রভাব গত শীতেই কিছুটা দেখা গিয়েছে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের।
গবেষকেরা পরামর্শ দিয়েছেন, শহরের বাতাসে পিএম ২.৫-এর মাত্রা যাতে প্রতি ঘনমিটারে ৭০ মাইক্রোগ্রামের বেশি না হয়, তা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে জরুরি। কারণ, এক বার ওই সীমা ছাড়িয়ে গেলে বাতাসের বিষাক্ত মাত্রা দ্রুত বেড়ে তা মানুষের স্বাস্থ্যের উপরে চরম প্রভাব ফেলতে পারে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)