চার মাস আগেও ট্যাংরার অতল শূর রোডের ছবিটা ছিল অন্য রকম। দিদির সঙ্গে গাড়িতে চেপে স্কুলে যেত বছর চোদ্দোর প্রতীপ দে। ছিল ছ’জনের হাসিখুশি পরিবার। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারির এক রাত জীবনই বদলে দিয়েছে তার। মা, কাকিমা, দিদি নেই। জেলে রয়েছেন বাবা, কাকা। শিশুকল্যাণ সমিতির সৌজন্যে কলকাতার একটি ‘হোম’ই এখন প্রতীপের ঠিকানা। ইতিমধ্যে সেখানে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছে প্রতীপের। ভর্তি করানো হয়েছে এনআরএসে। দুর্ঘটনার কারণে আগে থেকেই তার পায়ে চোট ছিল। তার উপর আবার চোট লাগায় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে তাকে।
সম্প্রতি অবশ্য হোমের তরফ থেকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে প্রতীপকে। এর আগে সে ট্যাংরার একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়়ত। সপ্তম শ্রেণির পরীক্ষা চলাকালীনই ঘটেছিল সেই ঘটনা, যা এক লহমায় মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তার জীবনের। তার পর চার চারটে মাস পেরিয়ে গিয়েছে। এত দিনে কলকাতার সেই ‘হোম’ই ঘর হয়ে উঠেছে প্রতীপের। আগের স্কুল থেকে টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) নিয়ে সদ্য নতুন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে সে। শুরু হয়েছে নতুন এক ‘জীবনযুদ্ধ’। যুদ্ধই বটে!
দে পরিবারের বিপর্যয়ের পর প্রাথমিক ভাবে আত্মীয়স্বজনেরা কেউই প্রতীপের দায়িত্ব নিতে চাননি। পরে তারই মৃতা কাকিমা রোমি দে-র বাবা, মা এগিয়ে আসেন। শিশু কল্যাণ সমিতির কাছে চিঠি দিয়ে জানান, তাঁদের মেয়ের জায়ের সন্তানকে তাঁরা সন্তানস্নেহে বড় করতে চান। কিন্তু তা-ও এখন বিশ বাঁও জলে। কারণ, প্রতীপ প্রায় পনেরোর দোরগোড়ায়। বাবা প্রণয় দে-ও বেঁচে রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে চাইলেই কাউকে দত্তক নেওয়া যায় না। তবে চেষ্টায় কমতি রাখছে না শিশু কল্যাণ সমিতি (সিডব্লিউসি)। সিডব্লিউসি (কলকাতা)-র চেয়ারপার্সন মহুয়া শূর রায়ের কথায়, ‘‘প্রতীপ দাদু-ঠাকুরমার কাছে থাকবে কি না, সে বিষয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট এখনও আসেনি। সাধারণত এ ধরনের ক্ষেত্রে সামাজিক অনুসন্ধান রিপোর্ট প্রয়োজন হয়, জেলার শিশু সুরক্ষা কমিটির সদস্যেরা সংশ্লিষ্ট বাড়িতে গিয়ে সব কিছু খতিয়ে দেখেন। ফলে এ ক্ষেত্রেও দাদু-ঠাকুমা সত্যিই দত্তক নিতে আগ্রহী কি না, তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থা কী রকম, সেখান থেকে স্কুলে যেতে পারবে কি না— সে সব খতিয়ে দেখে তার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’
আরও পড়ুন:
অগত্যা, আপাতত কলকাতার সরকারি হোমই প্রতীপের ঠিকানা। সেখানে থেকেই মূলধারার জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে ওই কিশোর। সূত্রের খবর, মিতভাষী প্রতীপ দাবা খেলতে ভালবাসে। কখনও অল্পস্বল্প কথাও বলে। সম্প্রতি গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পেও অংশ নিয়েছে। নতুন স্কুল, নতুন বন্ধুবান্ধব— আগের ধাক্কা সামলে উঠে ফের নতুন করে শুরু করতে সময় তো লাগবেই। তবে সমবয়সিদের সঙ্গে মেলামেশা কিশোরমনের মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল হবে বলেই মনে করছে শিশু কল্যাণ সমিতি।
ঘটনার সূত্রপাত গত ১২ ফেব্রুয়ারি। যে দিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বদলে গিয়েছিল প্রতীপের জীবন। সেই ভোরেই ট্যাংরার অতল শূর রোডের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল দে পরিবারের দুই বধূ এবং এক কিশোরীর দেহ। নিহতেরা ছিলেন প্রতীপের মা সুদেষ্ণা দে, কাকিমা রোমি দে এবং খুড়তুতো দিদি প্রিয়ম্বদা। অভিযোগ, তিন জনকে খুনের পর দেহগুলি বাড়িতে রেখে প্রতীপ ও তার বাবা প্রণয়কে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন কাকা প্রসূন। উদ্দেশ্য ছিল আত্মহনন। ভোররাতে তাঁদের গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। তিন জনই গুরুতর জখম হন। দীর্ঘ দিন এনআরএস হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর সুস্থ হয়ে ওঠেন প্রসূন, প্রণয়েরা। সেরে ওঠার পর খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় দু’জনকেই। মাঝে আদালতে গিয়ে বাবা-কাকার বিরুদ্ধে গোপন জবানবন্দিও দিয়ে এসেছে প্রতীপ। সেই তদন্ত না হয় চলবে তদন্তের মতো। তবে প্রতীপের ভবিষ্যৎ কী হবে? সে প্রশ্নের উত্তর নেই।