E-Paper

‘মণ্ডপে গেলেই বাবার কথা মনে পড়বে, মাকে নিয়ে যাব কী করে?’

কোথাও জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, কোথাও বা জমা জলে ডুবে পুজোর মুখে প্রাণ গিয়েছে অনেকের। তাঁদের পরিবার কেমন আছে, খোঁজ নিল আনন্দবাজার।

চন্দন বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:২৪
জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত শুভ প্রামাণিকের পরিবার। ঠাকুরপুকুরে।

জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত শুভ প্রামাণিকের পরিবার। ঠাকুরপুকুরে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

পুজোর মুখে এক রাতের বৃষ্টি যে এ ভাবে এলোমেলো করে দেবে সব কিছু, তা এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না কেউ কেউ। পুজোর শহর উৎসবের আমেজে থাকলেও ওই পরিবারগুলিকে যেন অন্ধকার ঘিরে রয়েছে। উৎসব তো দূর, স্বজন হারানোর শোক সামলে কী ভাবে আগামী দিনে পথ চলবেন তাঁরা, সেই দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃতদের পরিজনেরা।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর বৃষ্টিতে জলমগ্ন শহরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ন’জনের। রাস্তায় যে ‘মৃত্যু-ফাঁদ’ পাতা রয়েছে, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তাঁরা। কেউ কাজে যাওয়ার পথেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন, কেউ আবার কারখানার ভিতরে জমা জলে কাজ করার সময়ে। সেই মঙ্গলবার সকালে জমা জল ঠেলে কারখানায় কাজে গিয়ে আর ফেরেননি বছর পঁচিশের শুভ প্রামাণিক। শখেরবাজারে প্লাস্টিকের কারখানার ভিতরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন তিনি। দ্রুত এম আর বাঙুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও শেষরক্ষা হয়নি।

ঠাকুরপুকুর থানার পূর্ব বড়িশা এলাকায় থাকতেন শুভ। মাস ছয়েক আগে বিয়ে করেছিলেন। বাবা বাড়ির সামনে চায়ের দোকান চালান। সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, চায়ের দোকান বন্ধ। পুজো মণ্ডপে গান বাজার শব্দ কানে এলেও তাঁদের ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা। শুভর বাবা মদন প্রামাণিক বললেন, ‘‘বিয়ের পরে ছেলের প্রথম পুজো। কত আনন্দ করবে, ঠিক করে রেখেছিল। জামাকাপড়ও কেনা হয়েছিল। কিন্তু ও সব এখন কে পরবে?’’ চোখের জল ফেলতে ফেলতে যখন কথাগুলো বলছিলেন তিনি, তখন পাশে বসে বাবাকে সামলাচ্ছিলেন শুভর দাদা শুভঙ্কর। শুভঙ্কর বললেন, ‘‘যে দিন ঘটনাটি ঘটে, সে দিন বিকেলেও বন্ধুদের সঙ্গে কেনাকাটা করতে যাওয়ার কথা ছিল ওর।’’ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শুভর এই মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি তাঁর পরিবার। তদন্ত চেয়ে হরিদেবপুর থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন তাঁরা। মা ছায়া প্রামাণিক বললেন, ‘‘আইনে তো বিচার হবেই। কার গাফিলতিতে আমার ছেলেকে এ ভাবে চলে যেতে হল, ঈশ্বরও তার বিচার করবেন।’’

শুধু শুভ নন, সে দিন সকালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে রাস্তার জমা জলে পড়ে ছিলেন গরফার বাসিন্দা রামগোপাল পণ্ডিত। বছর তিপ্পান্নর রামগোপালকে গরফা থানা এলাকার কালিকাপুর মোড়ের কাছে পাওয়া যায়। মৃতের স্ত্রী কমলা পণ্ডিত জানালেন, আনন্দপুরের কাছে একটি সংস্থার গাড়ি চালাতেন রামগোপাল। ডিউটিতে যাওয়ার জন্য বৃষ্টি থামলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলেন। কমলার কথায়, ‘‘আমি বাড়িতে ছিলাম না। সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ বাড়িতে ফোন আসে। জানতে পারি, আমার স্বামী রাস্তায় পড়ে রয়েছেন। এর পরে আমরা যখন পৌঁছই, তত ক্ষণে সব শেষ।’’

গরফা মেন রোডে মণ্ডলপাড়ায় দুই কামরার ফ্ল্যাটে স্ত্রী এবং ছোট মেয়েকে নিয়ে থাকতেন রামগোপাল। বড় মেয়ের কয়েক বছর আগেই বিয়ে দিয়েছেন। পাড়ার পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন রামগোপাল। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে পুজোর আয়োজনে কাটছাঁট করা হয়েছে। মাকে সামলাতে আপাতত বড় মেয়ে মমতা ওই বাড়িতে এসে থাকছেন। তিনি বললেন, ‘‘পুজোয় বাবাকে বাড়িতেই পাওয়া যেত না। মণ্ডপে নানা কাজে থাকতেন। মণ্ডপে গেলেই বাবার কথা মনে পড়বে, মাকে নিয়ে যাব কী করে?’’

জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে মগরাহাটের মুলটির বাসিন্দা পবন ঘরামির (৪০)। মিন্টো পার্কের কাছে একটি হোটেলে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করতেন তিনি। হোটেল চত্বরে নামতেই আচমকা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন পবন। বাড়িতে রয়েছেন বৃদ্ধা মা, স্ত্রী এবং বছর ছয়েকের কন্যা। পবনের রোজগারেই সংসার চলত। তাঁর মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়েছে গোটা পরিবার। মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবেন, কী করবেন, জানেন না পবনের স্ত্রী মান্টি ঘরামি। তাঁর কথায়, “আমরা পুরো অসহায় হয়ে গেলাম। জানি না, এর পরে কী হবে।” স্বামীর মৃত্যুর পরে এখনও পর্যন্ত কোনও রকম সাহায্য মেলেনি বলেই জানান তিনি।

এই ঘটনায় বিদ্যুৎ বণ্টনকারী সংস্থা ও হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছেন পরিবারের সদস্যেরা। তাঁদের অভিযোগ, বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে হোটেলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। মৃতের আত্মীয় সুদীপ সেনগুপ্ত বলেন, “গাফিলতির জেরেই ভাইয়ের প্রাণ গিয়েছে। এর দায় বিদ্যুৎ বণ্টনকারী সংস্থাকে নিতেই হবে। সঠিক বিচার চাই আমরা।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Sakher Bazar Electronics

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy