Advertisement
E-Paper

দু’টি উড়ালপুলের খোলনলচে বদলানোর কাজ শুরু শীঘ্র, ব্যয় প্রায় ১০০ কোটি! দিন-রাত বন্ধ রাখতে হতে পারে যান চলাচল

কলকাতার রাস্তাঘাটের দুরবস্থা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। উড়ালপুলে উঠেও রেহাই নেই! পিচের ‘চামড়া’ উঠে দিকে দিকে বেরিয়ে পড়ছে নুড়িপাথরের কঙ্কাল। সময়ে-অসময়ে লাফিয়ে উঠছে গাড়ি। বৃষ্টিতে জল জমার ঘটনাও ঘটছে।

সারমিন বেগম

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৫ ১০:৩৬
গড়িয়াহাট সেতুতে রাস্তার পিচ উঠে গর্ত তৈরি হয়ে গিয়েছে।

গড়িয়াহাট সেতুতে রাস্তার পিচ উঠে গর্ত তৈরি হয়ে গিয়েছে। —নিজস্ব চিত্র।

‘স্বাস্থ্যপরীক্ষা’ আগেই হয়েছিল। তাতে ‘রোগ’ ধরাও পড়েছে। কিন্তু সাময়িক ‘ব্যথাহরা’ ব্যবস্থায় আর কাজ চলছে না। কলকাতার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উড়ালপুলের আদ্যোপান্ত অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। সেই তোড়জোড়ই শুরু করেছেন হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনার্সের (এইচআরবিসি) বিশেষজ্ঞেরা। এত দিন উড়ালপুলের রাস্তা খারাপ হলে পিচের আস্তরণ চাপিয়ে কোনও রকমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই মলমে আর আস্থা রাখা যাচ্ছে না। আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস রোড (এজেসি বোস রোড) উড়ালপুল এবং গড়িয়াহাট উড়ালপুলের খোলনলচে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে। সংস্কারের প্রয়োজনে এই দুই উড়ালপুলই বেশ কিছু দিনের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হতে পারে। সংস্কারের কাজে ব্যয় হতে পারে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

ঝড়বৃষ্টির মরসুম শেষে জলকাদা শুকোতেই কলকাতার রাস্তাঘাটের দুরবস্থা প্রকট হতে শুরু করেছে। এমনকি, উড়ালপুলে উঠেও রেহাই নেই! পিচের ‘চামড়া’ উঠে দিকে দিকে বেরিয়ে পড়ছে নুড়িপাথরের কঙ্কাল। সময়ে-অসময়ে লাফিয়ে উঠছে গাড়ি। এজেসি বোস রোড উড়ালপুল এবং গড়িয়াহাট উড়ালপুল দীর্ঘ দিন ধরেই বিশেষজ্ঞদের নজরে রয়েছে। এইচআরবিসি জানিয়েছে, সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি সংগ্রহের কাজ চলছে। তা শেষ হলেই ‘অস্ত্রোপচার’ শুরু হবে। অবস্থা ঠিক কতটা করুণ? উড়ালপুলগুলির ‘স্বাস্থ্যের’ খোঁজ নিতে গিয়েছিল আনন্দবাজার ডট কম। গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ‘হোঁচট’ খেতে হল। কোথাও সেতুর মাঝে এবড়োখেবড়ো পিচ, তো কোথাও সেতুতে ওঠার মুখেই গর্ত।

শহরের উড়ালপুলে রাস্তার বেহাল দশা।

শহরের উড়ালপুলে রাস্তার বেহাল দশা। —নিজস্ব চিত্র।

পার্ক সার্কাস (বেকবাগান) থেকে এক দিকে ‘মা’ উড়ালপুল এবং অন্য দিকে এসএসকেএম হাসপাতাল পর্যন্ত তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এজেসি বোস রোড উড়ালপুল। বাইপাসের দিক থেকে যাঁরা মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতার দিকে আসেন অথবা যাঁরা সল্টলেক বা বারুইপুরের দিক থেকে হাওড়ার দিকে যান, তাঁদের কাছে এই উড়ালপুল গুরুত্বপূর্ণ। শহরের অন্যতম ব্যস্ত এই উড়ালপুল মাস দশেক আগেই এক বার মেরামত করা হয়েছিল। টানা ১৫ দিন যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে সংস্কারের কাজ হয়েছিল এজেসি বোস রোডের উড়ালপুলে। কিন্তু কোথায় কী! সেতুর উপরে বিস্তীর্ণ অংশে পিচের আস্তরণ উঠে গিয়েছে। জায়গায় জায়গায় অমসৃণ, এবড়োখেবড়ো রাস্তা। বিশেষ করে উড়ালপুলের দু’ধারে তা বেশি করে চোখে পড়ে। ওই অংশের উপর দিয়ে যেতে গেলে অনিবার্য ভাবে লাফিয়ে ওঠে গাড়ি। পিচ-ওঠা অংশগুলিকে পাশ কাটাতে গিয়ে চালকেরা যানজটে জড়িয়ে পড়েন। সকালের ব্যস্ত সময়ে যানজট আরও তীব্র হয়।

উড়ালপুলের মাঝে রাস্তায় ছোট ছোট গর্ত।

উড়ালপুলের মাঝে রাস্তায় ছোট ছোট গর্ত। —নিজস্ব চিত্র।

এজেসি বোস রোড উড়ালপুল নেমেছে রেসকোর্সের কাছে এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার সেন্টারের একেবারে সামনে। ফলে এই উড়ালপুল দিয়ে প্রতি দিন অনেক রোগীও যাতায়াত করেন। ঝাঁকুনি সহ্য করতে হয় অ্যাম্বুল্যান্সকে। উড়ালপুল থেকে নামার পর হাসপাতালের সামনের রাস্তাটিও এবড়োখেবড়ো। একাধিক জায়গায় পিচের ছাল উঠে গিয়েছে। রোগী এবং তাঁদের পরিজনদের কাছে সেই রাস্তা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কৌতূহলের বিষয় হল, এজেসি বোস রোড উড়ালপুল সংলগ্ন ‘মা’ উড়ালপুলের রাস্তার হাল কিন্তু এমন নয়। সেখানকার রাস্তা মসৃণ এবং ঝকঝকে। মা উড়ালপুলের সঙ্গে জুড়ে থাকার কারণেই এজেসি বোস রোড উড়ালপুলের ঝাঁকুনি নিত্যযাত্রীদের কাছে আরও বেশি বিরক্তিকর।

এজেসি বোস রোড উড়ালপুলটি মেরামত এবং সংস্কার করতে প্রায় ৬০ কোটি টাকা খরচ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। এইচআরবিসি-র সেক্রেটারি জ্যোতিষ্মান চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজার ডট কম-কে বলেছেন, ‘‘গড়িয়াহাট এবং এজেসি বোস রোড উড়ালপুল— দু’টিই আমরা সম্পূর্ণ ভাবে মেরামত করতে চাইছি। শুধু উপরের প্যাচওয়ার্ক (পিচ ঢেলে সাময়িক মলম) নয়, এ বার পুরো সেতুই সারাই করা হবে। এজেসি বোস রোডের জন্য ৬০ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। বিশদ রিপোর্ট প্রশাসনকে জমা দেওয়া হয়েছে। অনুমতি মিললে কাজ শুরু হবে।’’

গড়িয়াহাট সেতু থেকে নামার পর রাস্তার অবস্থা।

গড়িয়াহাট সেতু থেকে নামার পর রাস্তার অবস্থা। —নিজস্ব চিত্র।

বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড এবং রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক রোডের ক্রসিং পর্যন্ত বিস্তৃত গড়িয়াহাট উ়ড়ালপুল। মাত্র ৫৭১ মিটার দীর্ঘ হলেও এই উড়ালপুল দক্ষিণ কলকাতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর বা মধ্য কলকাতার দিক থেকে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস না ধরে যাঁরা যাদবপুরের দিকে আসেন, গড়িয়াহাট বাজারের ভিড় যাঁরা এড়াতে চান, তাঁরা নীচের জট এই উড়ালপুলে উঠে পেরোতে পারেন। কিন্তু এখানেও রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। মসৃণ কোনও অংশ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর! সর্বত্র পিচ ক্ষয়ে বেরিয়ে এসেছে ছোট ছোট পাথর। সেতুর মাঝের দিকে একটি অংশে রাস্তার ছাল উঠে রীতিমতো গর্ত তৈরি হয়ে গিয়েছে। তার উপর দিয়েই গাড়ি চলছে। বছরখানেক আগে এই উড়ালপুলের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করানো হয়েছিল। জ্যোতিষ্মানের কথায়, ‘‘গড়িয়াহাট উড়ালপুল অনেক দিন ধরেই আমাদের নজরে রয়েছে। স্বাস্থ্যপরীক্ষার পরে সেটি সারাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গড়িয়াহাট উড়ালপুল সংস্কারে আনুমানিক ৩৪ কোটি টাকা খরচ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রশাসনের অনুমতি নেওয়ার কাজও বেশ কয়েক ধাপ এগিয়েছে। এই প্রক্রিয়া শেষ হলেই সংস্কারের কাজ শুরু করা যাবে।’’ তবে যে ধরনের কাজের পরিকল্পনা রয়েছে, তাতে উভয় উড়ালপুলের ক্ষেত্রেই কিছু দিনের জন্য যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হতে পারে। সাধারণত, শহরে কোনও সেতু সংস্কারের কাজ হলে রাতে ওই সেতু কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে কাজ করা হয়। এ ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। দিন এবং রাতের পুরো সময়েই উড়ালপুর পুরোপুরি বন্ধ রাখতে হতে পারে।

কী কী কাজ হবে?

সাধারণত ছোটখাটো সংস্কারের সময়ে রাস্তায় ছ’মিলিমিটার পুরু পিচের আস্তরণ দেওয়া হয়। তা কয়েক মাসের মধ্যে উঠেও যায় বলে মানছেন বিশেষজ্ঞেরা। এইচআরবিসি সূত্রে খবর, দুই উড়ালপুলের রাস্তা যাতে অন্তত কয়েক বছর ভাল থাকে, এ বার সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই সেতু টেকসই করার কথা মাথায় রেখেই সংস্কার শুরু হবে। শুধু উপরে নয়, কাজ হবে উড়ালপুলের নীচেও। স্ল্যাবের নীচে বেয়ারিং পাল্টানো হবে। এজেসি বোস রোড উড়ালপুলের অন্যতম প্রধান সমস্যা জল। বৃষ্টি হলে এখানে জল জমে থাকে। পিচের পক্ষে এই জল ক্ষতিকারক। তাই নতুন করে সংস্কারের সময় জল বার করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। উন্নত করা হবে নিকাশি ব্যবস্থা।

জীবনানন্দ সেতুতে রাস্তার মাঝের ফাঁক থেকে নীচের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।

জীবনানন্দ সেতুতে রাস্তার মাঝের ফাঁক থেকে নীচের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। —নিজস্ব চিত্র।

গড়িয়াহাট থেকে যাদবপুরের দিকে এগিয়ে গেলে বাঁ দিকে পড়ে জীবনানন্দ সেতু। বাইপাস ও যাদবপুর-প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড সংযোগকারী এই সেতু দৈর্ঘ্যে খুব একটা বড় নয়। তবে প্রতি দিন বহু গাড়ি এখান দিয়ে যাতায়াত করে। সামনেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, অনতিদূরে রয়েছে সাউথ সিটি শপিং মল এবং একাধিক স্কুল। সন্ধ্যার দিকে এই সেতুতে যানজট বেড়ে যায়। বাইপাসের দিক থেকে এলে জীবনানন্দ সেতুতে ওঠার মুখে রাস্তার অবস্থা খারাপ। পিচ উঠে বিস্তীর্ণ অংশে ছোট ছোট গর্ত তৈরি হয়েছে। সেতুর উপরে উঠে যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তা আরও ‘চমকপ্রদ’। এই সেতুর এক ধারে হাঁটাচলার জন্য ফুটপাত রয়েছে। সেখান থেকে রাস্তার মাঝের গর্ত দিয়ে সেতুর নীচের দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে! অর্থাৎ, পিচ উঠে সেতুর ওই অংশ ভেঙে নীচে পড়ে গিয়েছে। এ ছাড়াও সেতুর মধ্যে এই ধরনের একাধিক ফাঁক রয়েছে, যেখান থেকে নীচের অংশ দেখা যায়। এই ধরনের ফাঁকা অংশ বিপজ্জনক তো বটেই, হাঁটতে গিয়েও কারও পা আটকেও যেতে পারে যখন তখন। এই সেতুতেও কিছু দিন আগে পিচের প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল। কলকাতা পুরসভার রাস্তার দায়িত্বে রয়েছেন অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। তিনি অবশ্য বলছেন, সেতু সংস্কারের দায়িত্ব পুরসভার নয়। তবে মাঝেমধ্যে পুরসভার তরফে শহরের উড়ালপুলগুলি পরিদর্শন করা হয়। কোথায় কী সংস্কার দরকার, তা চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। বিভিন্ন রাস্তায় পিচ উঠে যাওয়ার জন্য বৃষ্টির মরসুমকে দায়ী করেছেন অভিজিৎ!

Kolkata Flyover Flyover Maintenance HRBC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy