Advertisement
E-Paper

হকারদের ডালা, ঠেলাভ্যান আর রিকশায় অবরুদ্ধ শিয়ালদহের মেট্রো স্টেশনের ফটক! যাত্রীরা তিতিবিরক্ত, কিন্তু রেল ‘অসহায়’

হকার নেতৃত্ব বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তাঁদের মতে, এই সমস্যার নেপথ্যে রয়েছে ‘টাকার চক্র’। তবে পিছনে যা-ই থাকুক, শিয়ালদহ থেকে মেট্রো ধরা যাত্রীদের কাছে এক দৈনন্দিন আতঙ্ক!

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৫ ০৯:৫৯
Sealdah Metro Station is surrounded by hawkers, why is that and what problems does it cause for passengers

শিয়ালদহ মেট্রো স্টেশনের বাইরে হকার-ঠাসা চত্বর। —নিজস্ব চিত্র।

শিয়ালদহ মেট্রো স্টেশনে ঢোকার উপায় নেই! গোটা স্টেশন চত্বর ঘিরে ‘রাজত্ব’ করছে হকার বাহিনী। শুধু স্টেশন চত্বর নয়, বি আর সিংহ হাসপাতালের সামনে থেকে শুরু করে কোলে মার্কেটের মুখ পর্যন্ত রাস্তার দখল সারা দিন হকার এবং তাঁদের ঠেলাগাড়ির।

রাতের অবস্থাও তথৈবচ! যাত্রীদের যাতায়াত তো বটেই, গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রেও যা বড় বাধা। ট্রেন বা মেট্রো ধরার তাড়ার সময় এই হকারবাহিনীর দাপট যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের। রেল যদিও হকার-দাপটের দায় চাপাচ্ছে রাজ্য পুলিশের উপরে। আর রাজ্য পুলিশের যথাবিহিত দাবি, নিয়মিত ওখান থেকে হকার উচ্ছেদ হয়। পুলিশ ফিরে গেলে আবার বসে পড়েন তাঁরা। হকার ইউনিয়নের নেতৃত্বও বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, তাঁদের ভ্যানরিকশা বা ঠেলাগাড়ির হকারদের কোনও সংগঠন নেই। বিরোধী হকার ইউনিয়নের অভিযোগ, সমস্যার নেপথ্যে রয়েছে ‘টাকার চক্র’। তবে পিছনে যা-ই থাকুক, শিয়ালদহ থেকে মেট্রো ধরা যাত্রীদের কাছে এখন এক দৈনন্দিন আতঙ্ক!

২০২২ সালের ১২ জুলাই শিয়ালদহ মেট্রো স্টেশন চালু হয়েছিল। চলতি বছরের ২২ অগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উদ্বোধন করেছেন শিয়ালদহ-হাওড়া ময়দান সংযোগকারী মেট্রো পরিষেবা। তার পর থেকেই শিয়ালদহ মেট্রো স্টেশনে ভিড় বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। প্রতি দিন হাজার হাজার যাত্রী এই মেট্রো স্টেশন ব্যবহার করেন।

শিয়ালদহ মেট্রো স্টেশনের প্রবেশপথটি অর্ধবৃত্তাকার। শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল, প্রবেশপথ-সহ গোটা স্টেশন চত্বর ঘিরে ওই অর্ধবৃত্তেই ঘিরে হকারেরা। স্টেশন আর তাঁদের মাঝে সামান্য দূরত্ব আছে বটে। কিন্তু স্টেশনে ঢোকার কোনও ‘পথ’ নেই। সব হকারেরই হয় ভ্যানরিকশা অথবা ঠেলাগাড়ি রয়েছে। তাতে পসরা সাজিয়ে চলছে মালপত্র বিক্রি। কেউ বিক্রি করছেন মোবাইলের ইয়ারফোন, কেউ নানাবিধ আলো, কারও ডালায় সিঙ্গাপুরি কলা, কারও বেদানা, কারও পেঁপে। কেউ ঠেলার উপর চালাচ্ছেন ডিম-পাউরুটি বা এগরোলের দোকান। হাঁকডাক করে ডাকছেন যাত্রীদের। কেউ কেউ কিনছেনও। কিন্তু এর গোটাটাই ‘বেআইনি’ বলে দাবি রেলের। ওই চত্বরে রেলের অনুমতি ছাড়া হকার বা ডালা বা ভ্যান-ঠেলাগাড়ি নিয়ে বসা নাকি নিয়মবহির্ভূত। দেখে অবশ্য তা বোঝার উপায় নেই! ভোগান্তি বাড়ছে যাত্রীদের।

সোদপুর থেকে প্রতি দিন লোকাল ট্রেনে এসে শিয়ালদহ থেকে মেট্রো ধরে ধর্মতলার কর্মস্থলে যান কমলাক্ষ দত্ত। তাঁর কথায়, ‘‘এই ঠেলাওয়ালাদের ঠেলে গুঁতিয়ে মেট্রোয় ঢুকতে হয়। একটা ঠেলার সঙ্গে অন্য ঠেলা গায়ে গায়ে লাগানো। ওঁদের দয়া না-হলে কোনও ভাবেই দুটো ঠেলার মাঝখান দিয়ে ঢোকা সম্ভব নয়। সেই দয়াও ওঁরা মাঝে মাঝে করেন না। তখন অন্য ফাঁকফোকর খুঁজতে হয়।’’ একই বক্তব্য কোন্ননগরের বাসিন্দা রূপা কর্মকারের। তিনি রোজ হাওড়া থেকে মেট্রো ধরে শিয়ালদহ নেমে লোকাল ট্রেনে দত্তপুকুরের কাছে স্কুলে যান। তাঁর বক্তব্য, ‘‘শিয়ালদহ স্টেশনে ঢোকার জন্য মেট্রো থেকে একটা পাতালপথ আছে। কিন্তু সেই পথ খুব একটা সুগম নয়। তাই বাইরে দিয়েই বেরোই। কিন্তু বেরোতে গিয়ে নানা ঝামেলা। হকারদের উপদ্রব এত বেশি, যে বেরোনোই দায়!’’

বেশ কয়েক বছর শিয়ালদহে কর্মরত রেলের এক আধিকারিকের মতে, এই হকারেরা মূলত ‘রাজনৈতিক ছত্রছায়া’য় থাকেন। ফলে রাজনৈতিক ভাবেই তাঁরা এলাকা ‘দখল’ করে আছেন। নানা ভাবে ওঠানোর চেষ্টা করেও লাভ হয় না। তাঁর কথায়, ‘‘রেল স্টেশন এবং রেললাইন দেখভালের দায়িত্ব আরপিএফের। আইনশৃঙ্খলা বজায়ের দায়িত্ব জিআরপির। স্টেশনের বাইরের চত্বরের দায়িত্ব রাজ্য পুলিশের। এই তিন পক্ষের চোখ এড়িয়ে তো হকারদের পক্ষে বসা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও একটা বোঝাপড়া আছে।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী এই স্টেশনে এলে তো হকার থাকবে না। তুলে দেওয়া হবে। কী করে হবে?’’ তাঁর মতে, রেল ও প্রশাসনের এক অংশের উদাসীনতা এবং তৎপরতাহীনতাই আসল কারণ। রাজনৈতিক কারণ তো আছেই। সঙ্গে আছে ‘অবৈধ লেনদেন’।

কেন তিনি যাত্রীদের অসুবিধা করে বসেছেন? কার অনুমতিতে? কলার ঠেলা নিয়ে দাঁড়ানো প্রদীপ ধরকে প্রশ্ন করায় তিনি নীরব রইলেন। পরমুহূর্তে হাঁক পেড়ে ডাকতে থাকেন খদ্দেরদের। আবার জিজ্ঞাসা করা গেল, ‘‘কাউকে পয়সা দিতে হয় এখানে বসার জন্য?’’ প্রদীপের চিৎকার দ্বিগুণ বেড়ে গেল। প্রশ্নের জবাব এল না।

মালিকানা অনুযায়ী মেট্রো স্টেশনের বাইরের ওই হকারঘেরা চত্বর পূর্ব রেলের। তাদের অনুমতি ছাড়া কোনও হকারেরই সেখানে বসা সম্ভব নয়। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক দীপ্তিময় দত্তের বক্তব্য, ‘‘ওই জায়গায় যে সমস্ত হকার বসেন, সবই অবৈধ। আমরা বার বার হকারমুক্ত চত্বরের জন্য বিভিন্ন পক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছি। মাঝে মাঝে কোনও হকার থাকেন না। তার পরে আবার ভরে যায়। হকার তুলে দেওয়া রাজ্য পুলিশের কাজ। সহায়তা করে আরপিএফ এবং জিআরপি। মাঝে মাঝে আমরাও অভিযান চালাই। কিন্তু পরে আবার যে কে সে-ই।’’ দীপ্তিময়ও ঠারেঠোরে হকারদের ‘রাজনৈতিক ছত্রছায়া’র কথাই বললেন।

মেট্টো কর্তৃপক্ষ অবশ্য হকারদের ‘দায়’ নিতে নারাজ। তাঁদের কথায়, ‘‘ওই চত্বরে হকারেরা বসেন বলে আগেও আমরা অভিযোগ পেয়েছি। কিন্তু ওটা পূর্ব রেলের জায়গা। আরপিএফ মাঝে মাঝে হকার তুলে দেয়। তবে পূর্ব রেল এবং রাজ্য প্রশাসন উদ্যোগী হলে পাকাপাকি হকারমুক্তি সম্ভব। আমাদের এ ব্যাপারে তেমন কোনও ভূমিকা নেই। তবে আমাদের সহযোগিতা চাওয়া হলে নিশ্চয়ই তা দেওয়া হবে। মেট্রো চত্বর হকারমুক্ত করতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত। কিন্তু সব তো মেট্রোর হাতে নেই।’’ বস্তুত, হকারদের ‘রাজনৈতিক প্রভাবে’র কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষও।

সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটু অনুমোদিত হকার্স ইউনিয়নের কলকাতা জেলার সম্পাদক গোপাল দাস রাজনীতি নিয়ে কী বলছেন? তাঁর জবাব, ‘‘কোভিড পরবর্তী সময়ে বহু মানুষ পেশা হারিয়ে এই ধরনের পেশায় যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের নানা চাপের মুখে থাকতে হয়। আরপিএফ, জিআরপির জুলুমের সঙ্গে স্থানীয় স্তরের তৃণমূল নেতাদের তোলা দিতে বাধ্য হন তাঁরা। এই সমস্যার নেপথ্যে রয়েছে টাকার চক্র।’’ সমস্যা সম্পর্কে অবহিত শাসকদলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র উত্তর কলকাতা জেলা সভাপতি তথা কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (বস্তি) স্বপন সমাদ্দারও। তবে তাঁর যুক্তি, ‘‘আমাদের ভ্যান রিকশা বা ঠেলাগাড়ির কোনও ইউনিয়ন নেই। তাই এ ক্ষেত্রে আমরা সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারি না। বড় জোর ওঁদের কাছে অনুরোধ করতে পারি, এখানে বসবেন না। ওই জায়গাটার একটা অংশ রেল পুলিশের আওতায়। বাকিটা কলকাতা পুলিশের মুচিপাড়া থানার অধীনে। আমরা তো আর আইন হাতে তুলে নিতে পারি না। কাজটা প্রশাসনের। যাত্রীদের সমস্যা হলে আলাপ-আলোচনা ও পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেই সমাধান সম্ভব।’’

মুচিপাড়া থানার আইসি ফোন ধরেননি। তাঁর বক্তব্য জানলে পারলে এই প্রতিবেদনে জুড়ে দেওয়া হবে। তবে বক্তব্যই সার। অভিজ্ঞতা বলছে, একে অপরের দিকে আঙুল তুলবেন। কেউ ‘দায়’ নেবেন না। যাত্রীদের সমস্যার ‘ঐতিহ্য’ সমানে চলিবে!

Sealdah Metro Sealdah station Kolkata Metro
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy