Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
COVID 19

এখনও বিশ্বাস করি, সব ঠিক হয়ে যাবে

সূর্যের গনগনে তেজ সবটুকু নুন-জল নিংড়ে বার করে দিত। এ-ই ছিল সংক্রমণের প্রথম পর্বের অভিজ্ঞতা।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

পিন্টু জানা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০২১ ০৭:১০
Share: Save:

পুলিশকে দেখে যে জীবনে এত শান্তি আর আনন্দ পাব, ভাবিনি কখনও। গত বছরের এপ্রিল। তাপমাত্রার পারদ ৩৮ থেকে ৪০-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। ট্রেন, বাস, মেট্রো, গাড়ি সম্পূর্ণ বন্ধ। শুনশান পথে দেখেছি কেবল উর্দিধারী মানুষ। আর যানবাহন বলতে হুশ করে বেরিয়ে যাওয়া অ্যাম্বুল্যান্স অথবা পুলিশের গাড়ি। আমাদের পরনে পিপিই নামক একটি পোশাক, যা অনেকটাই চন্দ্র অভিযানে যাওয়া নভশ্চরদের পোশাকের মতো। সেটা পরেই টানা সাত-আট ঘণ্টা থাকা। এসিহীন অ্যাম্বুল্যান্স হলে তো কথাই নেই! সূর্যের গনগনে তেজ সবটুকু নুন-জল নিংড়ে বার করে দিত। এ-ই ছিল সংক্রমণের প্রথম পর্বের অভিজ্ঞতা।

এর পরে সময় যত এগিয়েছে, নিজেকে বোঝাতাম, কেটে যাবে অন্ধকার। কিন্তু কিছু দিনের বিরতির পরে সংক্রমণ ফের বাড়তে দেখলে আতঙ্ক, হতাশা চেপে ধরত। মনে পড়ছে একটি রাতের কথা। নৈশ ডিউটি ছিল। সে দিন সব মিলিয়ে ন’জন রোগীকে শুধু আমার ট্রিপেই তুলেছিলাম। সেটাই আমার ক্ষেত্রে সর্বাধিক। যদিও সংক্রমণের বাড়াবাড়ির পর্যায়ে আমাদের কলকাতা পুরসভার কোনও কোনও কোভিড অ্যাম্বুল্যান্স ১৫ জন রোগীও তুলেছে। যা-ই হোক, সেই ভোরে রোগী নিয়ে যখন মা উড়ালপুল দিয়ে যাচ্ছি, সূর্য পুব আকাশে আগুনের গোলার মতো ভেসে উঠল। পিছনে তখন একা বৃদ্ধ রোগী। মনে হল, মানুষগুলো তো কখনও ভাবেননি যে, এ ভাবে পরিজনহীন হয়ে যেতে হবে! আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ছিল জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই গানটা, ‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার, ও কি সূর্য নাকি স্বপনের চিতা…’।

পুরনো বাংলা আর হিন্দি গানের রসিক আমি। এখনও বিশ্বাস করি, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। মানুষ নিয়ম মানে না, বোঝে না— এ কথাই চার দিকে শুনি। কিন্তু বোঝানোর মতো করে বোঝাতে আমরা কত জন চেষ্টা করেছি? তাই মাস কয়েক ধরে নিজের এলাকায় সচেতনতা প্রসারের কাজ করছি। এটাই আমার অবসর যাপনের উপায়।

উল্টোডাঙার জহর দত্ত লেনে আমার বাড়ি। গত বছর এই বস্তিতে সংক্রমণ মারাত্মক ভাবে ছড়িয়েছিল। প্রথমে ন’দিন এবং পরে আরও চার দিনের জন্য কন্টেনমেন্ট জ়োন হয়েছিল এই এলাকা। গত ১৪ সেপ্টেম্বর আমিও সংক্রমিত হই। বাড়িতে বৃদ্ধা মা আর স্ত্রী রয়েছেন। আমি নিজে সুগারের রোগী। পরিবারকে রক্ষা করতে তাই আনন্দপুরের সেফ হোমে চলে গিয়েছিলাম। সুস্থ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, নিজেও কিছু দায়িত্ব পালন করব। তাই যখনই সময় পাই, নিজের এলাকায় ঘুরে ঘুরে খোঁজ নিই। কেউ শারীরিক সমস্যার কথা জানালে তাঁকে সাধ্য মতো পরামর্শ দিই। মাস্ক পরা এবং বার বার হাত ধোয়ার গুরুত্ব বোঝাই। কাজের মধ্যে দিয়ে পরিস্থিতি কেমন বুঝলাম, সেটাও আড্ডার মেজাজে ব্যাখ্যা করি। এ সবে পরিবর্তন হল এটাই যে, জহর দত্ত লেনে এখন সংক্রমণ প্রায় নেই বললেই চলে। এখানে অনেকেই কিন্তু দুটো করে মাস্ক পরে থাকেন।

কষ্ট? সে তো এখন সকলেই জয় করেছি। সব থেকে প্রিয় মানুষকে সম্পূর্ণ একা, অপরিচিত মানুষের ভরসায় সৎকারে পাঠিয়ে দেওয়ার থেকে বড় কষ্ট আর কী আছে! সেটাও তো আমরা সহ্য করছি। তাই বাকি কষ্ট আসলে ভ্রম। এক মাস আগের ঘটনা। বেহালা আর কসবা থেকে রোগী তুলে মিলন মেলার সেফ হোমে যাচ্ছিলাম। বুঝতে পারলাম, শরীরটা বশে নেই। সঙ্গী স্বপন আচার্যকে বললাম, কোনও রকমে অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকিয়ে দিচ্ছি। বাকিটা তুই সামলে নিস। পৌঁছে প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থা হয়েছিল। স্বপন ওআরএস খাইয়ে, শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলে। পরদিন ফের কাজে গিয়েছি।

কারণ, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। এই ছ’টা শব্দই এখন পিন্টুর বিশ্বাস মন্ত্র।

(কোভিড অ্যাম্বুল্যান্স চালক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ambulance COVID 19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE