প্রতীকী ছবি।
লকডাউনে স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ার ঠিক মাস দুয়েক আগে মধ্য কলকাতার একটি কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শোরগোল ফেলেছিল। মুম্বইয়ের নামী গায়ককে আনার জন্য সেখানে পড়ুয়াদের থেকে মোটা টাকা তোলার অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি গড়ায় থানা পর্যন্ত। নানা মহলের প্রশ্নের মুখে সামনে আসে ওই কলেজের ছাত্র সংসদ তহবিলের টাকা নয়ছয়ের বিষয়টি। প্রশ্ন ওঠে, তবে কি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করানোই কলেজে পড়ে থাকা নেতা-দাদাদের টাকা কামানোরনতুন পথ?
সেই সময়ে কলেজে তদন্ত কমিটি গড়ে কড়া পদক্ষেপ করা হবে বলে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু কোথায় কী! তার কয়েক মাসের মধ্যেই লকডাউন হয়ে যায়। প্রায় দু’বছর বন্ধ থাকার পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেও তদন্তের কী হল, উত্তর মেলেনি। উল্টে সেই সময়ে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তাঁরাই এ বছরও ওই কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব পেয়েছেন।
জনপ্রিয় গায়ক কৃষ্ণকুমার কুন্নথ ওরফে কেকে-র মৃত্যুর পরে এখন জোর আলোচনা চলছে শহরের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির এমন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে। এই ধরনের শিল্পীদের দিয়ে গান গাওয়ানোর খরচ শুনে চোখ কপালে উঠছে অনেকেরই। যেখানে শিক্ষামূলক ভাল সেমিনার হয় না, সেখানে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কী ভাবে এত টাকা খরচ করে এমন অনুষ্ঠান করতে পারে, সেই প্রশ্নও উঠছে। সেই সূত্রেই উঠে আসছে আর্থিক অনিয়মের প্রসঙ্গ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শহরের যে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন চোখ ধাঁধানো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, সেখানে এলাকার রাজনৈতিক নেতা-দাদার প্রভাব রয়েছে চোখে পড়ার মতো। অভিযোগ, এই সব ক’টি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শিক্ষাকর্মী রয়েছেন যাঁরা দীর্ঘদিন ওই কলেজেই ছাত্র-রাজনীতি করেছেন। বর্তমানে তাঁদের হাতেই কলেজের ছাত্র সংসদ তহবিলের চাবিকাঠি। অভিযোগ, অনুষ্ঠান করার সময় এলেই এই নেতা-দাদারা কলেজের অধ্যক্ষের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেন। নিজের পছন্দের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাকে দিয়েই অনুষ্ঠান করাতে হবে বলে জানিয়ে দেন।এর অন্যথা হলে এলাকার নেতার নাম করে দেখে নেওয়ার হুমকি আসতে থাকে। অভিযোগ, দূরে কোথাও বদলি করে দেওয়ার চোখরাঙানিও মেলেযখন-তখন।
অধ্যক্ষ রাজি হয়ে গেলে ঠিক হয় পছন্দের শিল্পীর নাম। অভিযোগ, তাঁর পারিশ্রমিক যা-ই হোক, রাজি হয়ে যাওয়ার চাপ আসতে শুরু করে এর পরে। অধ্যক্ষ যদি টাকার প্রসঙ্গ তোলেন, তা হলে নেতা-দাদা তাঁকে বোঝান, ‘‘তহবিলে যা আছে দিন, বাকিটা আমি তুলব।’’ আদতে অনুষ্ঠান করতে যা খরচ, পছন্দের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার থেকে তার বেশি বাজেট করিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
দক্ষিণ কলকাতার এমনই একটি কলেজের পড়ুয়ার মন্তব্য, ‘‘আমরা ছাত্র রাজনীতি করি ঠিকই, কিন্তু আমাদের দাদাই সব দেখে। ২০১৭ সালের পর থেকে আর যে হেতু ভোট হয়নি, তাই তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলাও যায় না। কলেজের তহবিলের টাকা নিয়ে নেওয়ার পর অনুষ্ঠানের দিন মঞ্চে নানা লোককে তুলতে শুরু করেন দাদা। আমরা সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করে নিই। আসলে জানি, অনুষ্ঠানের জন্য ওই ব্যক্তিরা অনেক টাকা দিয়েছেন। টাকা যাঁরা দেন, তাঁদের মঞ্চে ডেকে খাতির তো করতেই হবে! বাজেট বাড়িয়ে আর বাইরে থেকে অনুদান তুলে দাদা কিছু নেন, কিছুটা আমাদের মধ্যে ভাগ হয়।" ওই পড়ুয়ার দাবি, কলেজে যিনি যত বেশি দিন রয়েছেন, টাকার ভাগ তিনি পান তত বেশি।
উত্তর কলকাতার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে সেখানকার এক ছাত্রের মন্তব্য, ‘‘কলেজের তহবিল থেকে টাকা নেওয়ার পরে নেতা-দাদা বাইরে থেকে কলেজের নাম ব্যবহার করে কত জনের থেকে টাকা তুলেছেন, তা অনুষ্ঠানের দিন আমন্ত্রিত এবং মঞ্চে ডেকে সংবর্ধনা দেওয়ার তালিকা দেখলেই বোঝা যায়। এর সঙ্গেই রয়েছে সরস্বতী পুজো, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং টাকা তোলারা আরও বিভিন্ন পথ।’’
হাজরা মোড়ের কাছে একটি কলেজের ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক আবার বললেন, ‘‘শুধু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়। পড়ুয়া ভর্তির সময়েও টাকার খেলা চলে। সব অনলাইনে করে দেওয়ার পরও এ সব বন্ধ হয়নি। যে শিক্ষাকর্মী আদতে ছাত্র সংসদের কাজ দেখেন, তিনিই ভর্তির মেধা তালিকায় কারচুপি করেদেন। তালিকায় কিছু ভুয়ো নাম ঢুকিয়ে রাখা হয়। সেই ভুয়ো নাম যেহেতু কোনও দিনও ভর্তি হতে আসবেন না, তাই ওই আসন পরে যে কাউকেবিক্রি করে দেওয়া যায়।’’
এই কারণেই কি কলেজের মেধা তালিকায় নাম থাকে সানিলিওনির? উত্তর মেলেনি। দক্ষিণ কলকাতার এক কলেজে মেধা তালিকায় ওই নাম থাকার অভিযোগের তদন্তের কিনারা হয়নি দু’বছর পরেও।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy