Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ভজাই-হায়দার দুই শিবিরেই উদ্বেগের ছায়া

উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পাশের সাদা বাড়িটাই মহিষবাথান (২) পঞ্চায়েতের অফিস। অন্যান্য কাজের দিনে এই অফিসটাই সরগরম থাকে। প্রধানের ঘরে ভিড় করে থাকেন লোকজন। কিন্তু বৃহস্পতিবার সেখানে ছবিটা একেবারে বিপরীত। পঞ্চায়েত অফিসের বাইরে ফিসফিস করে কথা বলছেন দুই যুবক। হাতে গোনা কয়েক জন বসে পঞ্চায়েত অফিসে।

মহিষবাথানে ভজাইয়ের পাড়ায় দিনভর পরিবেশ ছিল এমনই থমথমে।

মহিষবাথানে ভজাইয়ের পাড়ায় দিনভর পরিবেশ ছিল এমনই থমথমে।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৫ ০০:৩১
Share: Save:

উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পাশের সাদা বাড়িটাই মহিষবাথান (২) পঞ্চায়েতের অফিস। অন্যান্য কাজের দিনে এই অফিসটাই সরগরম থাকে। প্রধানের ঘরে ভিড় করে থাকেন লোকজন। কিন্তু বৃহস্পতিবার সেখানে ছবিটা একেবারে বিপরীত। পঞ্চায়েত অফিসের বাইরে ফিসফিস করে কথা বলছেন দুই যুবক। হাতে গোনা কয়েক জন বসে পঞ্চায়েত অফিসে। সেখানেই একটি ‘অ্যান্টি চেম্বার’-এর মতো ঘরে বসেছিলেন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক। তিনিই পঞ্চায়েতের প্রধান। আরও একটি পরিচয় তিনি সিন্ডিকেট মাফিয়া ভজাই সর্দারের ছেলে প্রসেনজিৎ সর্দার।

বালিগড়িতে হায়দর আলি মোল্লার পাড়াটাও থম মেরে রয়েছে। নিউ টাউন থেকে বালিগড়ির রাস্তায় ঢুকতে হায়দারের যে সিন্ডিকেটের অফিস ছিল, সেটি বন্ধ। সামনের চালাঘরেও বৃহস্পতিবার কোনও আড্ডা বসেনি। একই অবস্থা হায়দারের খাস তালুক শিরীষতলাতেও।

বুধবার ভজাই আর হায়দার গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই নিউটাউনের সিন্ডিকেট ব্যবসার পরবর্তী ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা ছিল এ দিনের নবাবপুর, ঘুনি, যাত্রাগাছির মতো এলাকায়। তবে সবটাই ফিসফাস আর গুঞ্জন। সাধারণ ভাবে কাজ যে বন্ধ ছিল, তা নয়, তবে কোথাও একটা থমথমে ভাব।

ভজাইয়ের দলবলের মতোই চিন্তার ছায়া তাঁর পরিবারেও। সকাল থেকে বেশ কয়েক বার ফোনে যোগাযোগ করার পরে দুপুর আড়াইটের পরে কয়েক মিনিটের জন্য কথা বলতে রাজি হয়েছিলেন প্রসেনজিৎ। শর্ত ছিল, ছবি তোলা যাবে না। পঞ্চায়েত অফিসের ভিতরেই ‘অ্যান্টি চেম্বার’-এ বসে কম্পিউটারে কাজ করছিলেন ভজাইয়ের ছেলে তথা পঞ্চায়েত প্রধান। কথাবার্তায় মানসিক চাপ যথাসম্ভব প্রকাশ না করার চেষ্টাই করছিলেন। শুধু তিনি একা নন। ভজাইয়ের বন্ধ অফিসের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যুবকদের সকলেই এ দিন ছিলেন বিষণ্ণ মুখে।

মাথার উপর থেকে বড় ছাতা সরে গিয়েছে। যে ছাতার নীচে চলত সিন্ডিকেট ব্যবসা-সহ সমগ্র নিউটাউন এলাকার অর্থনীতি আর রাজনীতি দখলে রাখার প্রশিক্ষণ। যদিও তা মানতে চাননি পঞ্চায়েত প্রধান প্রসেনজিৎ। তাঁর এমনও দাবি, তাঁর বাবা ভজাই সর্দার সিন্ডিকেট চালান বলে তাঁর জানা নেই। তাঁর বাবা অস্ত্র রাখেন বলেও তিনি বিশ্বাস করেন না। প্রসেনজিতের কথায়, ‘‘সকালে থানায় বাবার সঙ্গে দেখা করেছি। আইনজীবীরা পুরো বিষয়টি দেখছেন। দেখা যাক কী হয়।’’ মেনেও নিলেন অস্ত্র আইনে পুলিশ গ্রেফতার করায় তাঁদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে।

ভজাইয়ের সিন্ডিকেটের যুবকেরাই এ দিন জানান, এত দিন ভজাই এলাকা সামলাতেন। ব্যবসা সামলাতেন। তাঁর ছেলে পঞ্চায়েত প্রধান হওয়ায় রাজনৈতিক সুযোগসুবিধা নিয়েও বিশেষ চিন্তা ছিল না। কিন্তু বিধাননগর কর্পোরেশন হয়ে যাওয়ায় পঞ্চায়েতের বোর্ড ভেঙে গিয়েছে। আর কয়েক দিনেই প্রধানের পদ থেকে সরে যাবেন ভজাইয়ের ছেলে। আর ভজাই তো ইতিমধ্যেই লক-আপে। সেই চিন্তাতেই উদ্বিগ্ন তাঁর সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

তা সত্ত্বেও মহিষবাথানে এ দিন ভজাই ঘনিষ্ঠ শিবিরের একাধিক যুবক জানান, তাঁরা কেউ ক্লাস এইট পাশ, কেউ বা প্রাথমিকের গণ্ডীটুকু পেরিয়েছেন। জমি বিক্রির পরে চাষবাসের কাজ করারও সুযোগ নেই। নিউটাউনেই কোনও সংস্থায় ঝাড়ুদারের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা তাঁদের নেই। তাই রুটিরুজি চালাতে হলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইট-বালি-পাথর সরবরাহ করা ছাড়া আর কোনও উপায়ও তাঁদের নেই। ধরপাকড় যা-ই হোক না কেন।

এই কথাটাই বলতে চাইছেন নিউটাউন ও তার আশপাশে হাতিয়ারা, নবাবপুর, রায়গাছির মতো এলাকার লোকজন। ওই সব জায়গায় সিংহভাগ লোকজনই জুড়ে রয়েছেন প্রোমোটিং, সরবরাহের মতো ব্যবসায়। ফলে সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাঁদের নাড়ির যোগ সেই বাম আমল থেকে। এ দিন ওই সব জায়গায় ঘুরে সিন্ডিকেট নিয়ে কথা বলতে গেলে সরকারের প্রতিই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ওই সব গ্রামের বাসিন্দা শেখ কামাল ও মোস্তাকিনের বক্তব্য, সিঙ্গুরের জমি আদালতে আটকে গিয়েছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিনার পার্কে ফাইল নিয়ে গিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাজারহাটে বাম জমানায় জমি হারানো মানুষ জমি ফেরত পাবেন। তা হলে আজ অবধি কেন তার ব্যবস্থা মুখ্যমন্ত্রী করছেন না, প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।

অন্য দিকে, বালিগড়িতে হায়দারের দোতলা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কার্যত জেরার মুখেই পড়তে হল। পরে অবশ্য সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধির পরিচয় জেনে মুখ খুললেন হায়দারের স্ত্রী নিলুফা বিবি। তাঁর কথায়, ‘‘ছ’মাস হল পরিবারের আয় কমে গিয়েছে। আমাদের কাজের জায়গা ওরা দখল করে নিয়েছে। এমনকী বাড়ির কাছের হট-মিক্সিং প্লান্টটাও ওরা নিয়ে নিয়েছে।’’ ওরা কারা, উত্তর মেলেনি।

ছবি: শৌভিক দে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE