Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Health

মনের জোরেই সুস্থ জীবনে ফেরার স্বপ্ন শিক্ষকের

অভিষেকের শরীর থেকেই রক্ত নিয়ে ‘প্লেটলেট রিচ প্লাজমা’ থেরাপি দিয়ে সারানো হয় বেডসোর।

পাথেয়: পুরনো জীবনে ফেরার লড়াইয়ে অভিষেকের সঙ্গী সুরও। নিজস্ব চিত্র

পাথেয়: পুরনো জীবনে ফেরার লড়াইয়ে অভিষেকের সঙ্গী সুরও। নিজস্ব চিত্র

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২০ ০৩:১৬
Share: Save:

একটি দুর্ঘটনা থমকে দিয়েছিল জীবনের সাঁতার! অসাড় শরীরে সঙ্গী হয়েছিল বিছানা। হাত-পায়ের সাড় ফিরে আবার উঠে দাঁড়াতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছিল সংশয়। কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনেছে সব বাধা। এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসায় হাত-পা কিছুটা সচল হতেই ফের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা শুরু করেছেন ভবানীপুরের অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। করোনা-কালে ঘরে বসেই তিন পড়ুয়াকে নিয়ে শুরু করেছেন অনলাইন ক্লাস। অবসর সময়ে সুর তুলছেন বেহালায়।

২০১৮ সালের জুন মাস। সাঁতার কাটতে গিয়েই বদলে গিয়েছিল রুবি পার্কের বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক অভিষেকের জীবন। জলে ঝাঁপ দিতেই সুইমিং পুলের নীচের কংক্রিটে ধাক্কা লাগে। গুরুতর চোট পান ঘাড়ে। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেরুদণ্ড। অসাড় হয়ে যায় গোটা শরীর। দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে তেমন কোনও উন্নতি না হওয়ায় একমাত্র ছেলেকে ভেলোরে নিয়ে যান বাবা প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিন মাস সেখানে চলে চিকিৎসা। হাতে সামান্য জোর ফিরলেও শরীরের নীচের অংশ তখনও অসাড়। অগত্যা কলকাতায় বাড়িতে ফিরে আসেন অভিষেক। বিছানাতেই কাটে আরও তিন মাস। কোমরে হয়ে গিয়েছিল বেডসোর।

এক দিকে সেই ক্ষতের ব্যথা-বেদনা, অন্য দিকে হাত-পায়ের শক্তি ফিরে না আসার মানসিক যন্ত্রণায় ক্রমশ ভেঙে পড়তে থাকেন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস, ট্রেকিংয়ে অংশ নেওয়া অভিষেক। বললেন, ‘‘একটা সময়ে মানসিক জোরটাও একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল।’’ ২০১৯ –এর মে থেকে ফের শুরু হয় লড়াই। এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ফিজ়িক্যাল মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসা শুরু হয় অভিষেকের। ওই বিভাগের প্রধান চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক বলেন, ‘‘একটা তরতাজা জীবন স্তব্ধ হতে বসেছিল। তাই লড়াইটা শক্ত ছিল। কিন্তু রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের ইচ্ছাশক্তিই আজকের সাফল্য এনেছে।’’

আরও পডুন: আলোর মধ্যেই বসেছে ফুলঝুরি-তুবড়ির পসরা

আরও পডুন: ‘বাজি ফাটানোর সুযোগ থাকবে, এমন অবকাশ দেওয়াই যাবে না’

চিকিৎসকেরা জানান, দেখা যায় অভিষেকের শরীরের মাংসপেশী অসম্ভব রকম শক্ত হয়ে রয়েছে। হাতে খুবই সামান্য শক্তি ফিরলেও পা তখনও অসাড়। রাজেশবাবু জানান, ওই যুবকের চিকিৎসায় চারটি বিষয়ের উপরে জোর দেওয়া হয়েছিল। প্রথমত মানসিক জোর ফিরিয়ে আনা, দ্বিতীয় বড়সড় গর্তের আকার নেওয়া বেডসোর সারিয়ে তোলা, তৃতীয়ত হাত-পায়ের শক্তি ফিরিয়ে আনা এবং চতুর্থত শক্ত মাংসপেশীকে নরম করা।চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, হাতের শক্তি বাড়াতে বিভিন্ন থেরাপি শুরু করা হয়। পাশাপাশি মনের জোর বাড়াতে মিউজ়িক থেরাপিও চালু করা হয়।

সেই সময়ই চিকিৎসকেরা জানতে পারেন, বেহালা বাজাতে পারেন অভিষেক। তখনই তাঁর বাড়ি থেকে আনানো হয় সেই বাদ্যযন্ত্র। প্রথম প্রথম হাতের মুঠোয় বেহালা ধরতে অসুবিধা হত ওই শিক্ষকের। কিন্তু হারতে চাননি তিনি। হাসপাতালের মিউজ়িক থেরাপির ক্লাসেই মনের জোরকে হাতিয়ার করে বেহালায় সুর তুলতে থাকেন। বেডসোর সারাতে প্রথমে অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু মাংসপেশী এতটাই শক্ত ছিল যে, সেলাই ছিঁড়ে যায়। তখন অভিষেকের শরীর থেকেই রক্ত নিয়ে ‘প্লেটলেট রিচ প্লাজমা’ থেরাপি দিয়ে সারানো হয় বেডসোর। তার সঙ্গেই মাংসপেশী নমনীয় করতে বিশেষ ইঞ্জেকশনও দিতে থাকেন চিকিৎসকেরা। এর পরে আস্তে আস্তে উঠে বসা, ভর দিয়ে দাঁড়ানো শুরু করান চিকিৎসকেরা।

হাতের শক্তি ফিরতে দেখে চিকিৎসকদের পরামর্শে বাড়ি থেকে আসে ল্যাপটপ। অভিষেক বলেন, ‘‘রাজেশবাবুর উৎসাহেই আত্মজীবনী লিখতে শুরু করি। লকডাউনে লেখালেখিই মনটা ভাল রেখেছিল। উনি সব সময় বলতেন, ‘তুমি পারবেই`।’’ আর রাজেশবাবু বলছেন, ‘‘সলতেটা পাকিয়ে দিয়েছিলাম। তাতেই জীবনের প্রদীপ ফের জ্বালাতে পেরেছেন অভিষেক।’’ গত অগস্টে এসএসকেএম থেকে বকুলবাগান রোডের বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন ওই যুবক। এখন কোনও কিছুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতেও পারছেন।অভিষেক বিশ্বাস করেন, সামনে এগোনোর ইচ্ছাতেই জয় আসবে। আর সেই খুশিতেই অনলাইন পড়ানোর ফাঁকে বেহালায় বাজান ‘দুর্গা’ রাগ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Health Treatment Teacher Abhishek dstm
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE