গত দু’দশকে দেশে দায়ের হওয়া মাদক সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বেড়েছে ২৯৮ শতাংশ প্রতীকী ছবি।
গত দু’দশকে দেশে দায়ের হওয়া মাদক সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বেড়েছে ২৯৮ শতাংশ! ১৮ বছরের অনূর্ধ্বদের মধ্যে এর বৃদ্ধি দ্বিগুণেরও বেশি! সর্বশেষ প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’র (এনসিআরবি) এই রিপোর্টই বর্ষশেষের আগে চিন্তা বাড়িয়েছে তদন্তকারীদের। তাই বড়দিন এবং বর্ষবরণের উৎসবে মাদকের কারবারে লাগাম টানতে এই রিপোর্ট সামনে রেখেই তৈরি হচ্ছে কলকাতা পুলিশ।
আগামী কয়েক দিনের জন্য থানাগুলিকে যেমন ব্যাপক তল্লাশি ও ধরপাকড়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তেমনই শহরের ঢোকা-বেরোনোর রাস্তাগুলিতে নাকা-তল্লাশির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শুধুমাত্র ধর্মতলা, পার্ক স্ট্রিট এবং মধ্য কলকাতার হোটেল ও পানশালাগুলির জন্যই বড়দিনের রাতে সাদা পোশাকে প্রায় ৪৫০ পুলিশকর্মীকে মোতায়েন করা হচ্ছে। পার্টি বেশি হয়, শহরের এমন এলাকায় আগামী দু’সপ্তাহ থাকছে পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল। যৌথ ভাবে কাজ করার কথা ‘নার্কোটিক্স কন্ট্রোল বুরো’র (এনসিবি) অফিসারদেরও।
পুলিশি সূত্রের খবর, সমস্ত স্তরের অফিসারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কাউকে সন্দেহ হলেই তৎক্ষণাৎ তল্লাশি করে হেফাজতে নিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, প্রযুক্তির ব্যবহারের জোরে ‘কুরিয়র’-এর মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া মাদক এতে রোখা যাবে কি?
মাদক তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে মাদকের কারবার চলছে একাধিক গোপন পদ্ধতিতে। গত কয়েক বছরে ‘কুরিয়র’ পরিষেবার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ওই পথেই বিদেশ থেকে মাদক আনানো বেড়েছে। তার পরে সেই মাদকই পৌঁছে যাচ্ছে শীতের পার্টিতে। এ ছাড়াও, পুতুলের পেটে, গাড়ির সিট বেল্টের সঙ্গে মুড়িয়ে, জুতোর হিলের মধ্যে, কখনও বা মেক-আপের পাউডার ফেলে দিয়ে সেই বাক্সে প্রসাধনী সামগ্রীর মতো সাজিয়ে শহরে পাঠানো হয়েছে মাদক।
এ ভাবে মাদক পাচার করতে দেদার ব্যবহার হচ্ছে ‘ডার্ক ওয়েব’। মাদক কারবারিদের বেশির ভাগই টর ব্রাউজ়ার দিয়ে ডার্ক ওয়েবে ঢুকছে। সাইবার গবেষকেরা জানাচ্ছেন, এটি এক ধরনের গোপন ইন্টারনেট ব্যবস্থা। টর ব্রাউজ়ারে ব্যবহারকারীর আইপি (ইন্টারনেট প্রোটোকল) অ্যাড্রেস গোপন থাকে। এই পদ্ধতিতে ডার্ক ওয়েবে ঢুকলেই হাতে চলে আসে মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র, নিষিদ্ধ পর্নোগ্রাফির মতো একাধিক জিনিস। আইপি অ্যাড্রেস গোপন থাকায় ডার্ক ওয়েব থেকে ধরা যেমন কঠিন, তেমনই কঠিন কুরিয়র ধরা। কারণ, কোনও কুরিয়র সংস্থাই খামের ভিতরে কী রয়েছে, তা খুলে দেখে না। নিশ্চিত না হয়ে তদন্তকারীরাও খাম খুলে দেখার পথে হাঁটতে পারেন না। তদন্তকারীদের দাবি, এ ভাবেই কুরিয়রে আসা নাইট্রোসাম, স্প্যাজ়মোপ্রক্সিভন, সেকোবারবিটাল, ফেনমেট্রাজ়িন, মিথাকুইনোন, অ্যালপ্রাজ়োলাম, অ্যাটিভান, ক্যাম্পোসের মতো বহু অপ্রচলিত বা স্বল্প প্রচলিত মাদক ছড়িয়ে পড়ে শহরের পার্টিগুলিতে। দেখা যায়, গাঁজা, ক্রিস্টাল মেথ, এলএসডি, হাসিস, কোকেন, হেরোইন ছাড়াও একাধিক মাদক বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে সেবনের প্রবণতাও।
২০২০ সালে লোকসভায় এই প্রবণতার কথা তুলে মাদক-চিত্র জানতে চেয়েছিলেন বিজেপির এক সাংসদ। জবাবে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রত্তনলাল কাটারিয়া লোকসভায় জানান, দেশে ওই মুহূর্তে ১ কোটি ৪৪ লক্ষ ১৮-অনূর্ধ্ব কিশোর-কিশোরী কোনও না কোনও মাদক বা মদের নেশায় আসক্ত। মন্ত্রীর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে লকডাউনের সময়ে ৪০ লক্ষ কিশোর-কিশোরী আফিম জাতীয় নেশায় আসক্ত ছিল। ইনহ্যালেন্ট বা শুঁকে নেশায় আসক্তদের সংখ্যা অনূর্ধ্ব ১৮-দের মধ্যে ছিল প্রায় ৩০ লক্ষ। সেডেটিভ বা ঘুমের ওষুধ জাতীয় নেশায় আসক্ত ২০ লক্ষ কিশোর-কিশোরী। সদ্য প্রকাশিত এনসিআরবি-র মাদক মামলা সংক্রান্ত রিপোর্ট তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এমন মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির আশঙ্কাকেই কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘নার্কোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস’ (এনডিপিএস) আইনে অভিযোগ দায়ের বেড়েছে প্রায় ২৯৮ শতাংশ।
এনসিবি কলকাতার জ়োনাল ডিরেক্টর রাকেশচন্দ্র শুক্ল বললেন, ‘‘কড়া হাতে মামলা করা হচ্ছে বলেই এই সংখ্যা বেড়েছে। এই শীতের মরসুমে আরও কড়া হাতে দেশ জুড়ে ধরপাকড় চালানো হবে।’’ কলকাতা পুলিশের মাদক দমন শাখার এক আধিকারিকেরও মন্তব্য, ‘‘ডার্ক ওয়েবের জট অনেকটা কাটানো গিয়েছে। আগামী ১০ দিন সাধারণ মানুষই এগিয়ে এসে মাদক-বিরোধী অভিযানে অংশ নিন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy