Advertisement
E-Paper

‘বাজিই আমার ছেলেকে শেষ করেছে, লোকে বুঝবে কবে?’

পুজোর রাতেই মণ্ডপের সামনে তুবড়ির খোল ফেটে মৃত্যু হয় পুজো কমিটির সদস্য, বছর চল্লিশের দীপকুমার কোলের। হাসপাতালে ছুটলেও ভাঙা খোলের অংশ বার করা যায়নি।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২২ ০৯:৩১
স্মরণ: ভাইয়ের ছবি রেখে দোকান চালাচ্ছেন দীপ কোলের দাদা তপন। শনিবার। নিজস্ব চিত্র

স্মরণ: ভাইয়ের ছবি রেখে দোকান চালাচ্ছেন দীপ কোলের দাদা তপন। শনিবার। নিজস্ব চিত্র

বছর তিনেক আগেও পাড়ার মোড়ে কালীপুজো হত তোড়জোড় করে। রাত জেগে মণ্ডপ তৈরি করা, ঠাকুর আনা, দল বেঁধে বাজি কিনতে যাওয়া— পাড়ার ছেলেদের উৎসাহ তখন ছিল অন্য স্তরের। এক রাতে বদলে যায় সেই সব কিছুই। উৎসাহের সেই বাজিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল!

পুজোর রাতেই মণ্ডপের সামনে তুবড়ির খোল ফেটে মৃত্যু হয় পুজো কমিটির সদস্য, বছর চল্লিশের দীপকুমার কোলের। হাসপাতালে ছুটলেও ভাঙা খোলের অংশ বার করা যায়নি। কোনও মতে সে বার পুজো সামলে নেওয়া হয়। এর পর থেকে পুজোয় কারা নামাবেন, সেই লোকই পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। কোনও মতে পাড়ার এক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় ওই পুজো। গত দু’বছর সেখানেই নমো নমো করে পুজো সারা হয়েছে। কসবার উত্তরপাড়ার ওই ঘটনা স্থানীয়দের কাছে এখনও আতঙ্কের অধ্যায়!

কালীপুজোর এক দিন আগে শনিবার ওই এলাকায় গিয়ে মৃত যুবকের বাড়ি খুঁজে পেতে সমস্যা হল না। নাম শুনেই স্থানীয় এক ব্যক্তি চিনিয়ে দিলেন তাঁর বাড়ি। বললেন, ‘‘ওই ঘটনা ভোলার নয়। কালীপুজো এলেই মাথায় ঘুরতে থাকে। আমরা যাঁরা সামনে থেকে সবটা দেখেছিলাম, তাঁদের বাজির আওয়াজ শুনলেই এখনও বুক কেঁপে যায়।’’ সরু গলিপথে হেঁটে পাওয়া গেল দীপদের বাড়ি। বাড়ির নীচেই খাতা-বইয়ের দোকান রয়েছে তাঁদের। দীপ বিয়ে করেননি। তাঁর এক দাদা এবং ভাই ছাড়াও বৃদ্ধা মা রয়েছেন। দুই ভাই বিবাহিত। সকলেই এক বাড়িতে থাকেন। বাবার তৈরি খাতা-বইয়ের এই দোকান সামলাতেন দীপ। তাঁর মৃত্যুর পরে এখন দোকান দেখেন দীপের দাদা তপন কোলে। ছোট ভাই গৃহশিক্ষকতা করেন। দোকানের মুখেই টাঙানো দীপের একটি ছবি। সেটি দেখিয়েই তপন বলেন, ‘‘কালীপুজো নিয়ে ভাইয়ের খুব উৎসাহ ছিল। বন্ধুরা মিলে বাজি কিনতে যেত। সেই বাজিই আমার ভাইকে কেড়ে নিয়েছে।’’

দীপের মা, অশীতিপর ভারতী কোলে কানে ভাল শুনতে পান না। ঝুঁকে যাওয়া শরীর নিয়ে বাড়ির দিকে হেঁটে আসার পথে ছেলের কথা শুনেই কেঁদে ফেলেন। বললেন, ‘‘বহু দিন কেউ ওর খোঁজ করতে আসে না। তোমরা কি ওর বন্ধু? তোমাদের বন্ধু আর নেই। বাজির আগুন আমার ছেলেকে শেষ করে দিয়েছে।’’ বৃদ্ধা বলেন, ‘‘বাড়িতে আমার ছোট ছেলের দশ বছরের মেয়ে রয়েছে। সে বাজির বায়না করেছিল এ বারও। ওকে কোনও মতে বোঝানো হয়েছে বাজি ওর জেঠুকে কেড়ে নিয়েছে। আমাদের বাচ্চাটা না হয় অবুঝ, বড়রাও তো দেখি বোঝে না। ক্ষণিকের আনন্দের চেয়ে যে জীবন অনেক বড়, সেটা লোকে বুঝবে কবে?’’

একই আর্জি বেহালা ঢালিপাড়ার বাসিন্দা, বৃদ্ধা চম্পা দাস এবং তাঁর মেয়ে সুজাতার। চম্পার একমাত্র নাতি, বছর পাঁচেকের আদি দাসেরও জীবন কেড়েছে বাজি। ২০১৯ সালে কালীপুজোর রাতে ঠাকুরমার কিনে দেওয়া তুবড়ি ফাটাচ্ছিল সে। খোল ফেটে একটি টুকরো ঢুকে যায় আদির গলায়। ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় সে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এই ঘটনার পরে আদির মা চন্দ্রা আর স্বামী কাজলের সঙ্গে থাকতে চাননি। পুত্রহারা বাবা তড়িঘড়ি কাজে যোগ দিতে পারেননি। কিছু দিনের মধ্যেই লকডাউন হয়ে যায়। পরে আর তাঁকে কাজে নিতে চায়নি সংস্থা। ঢালিপাড়ায় আদিদের ঘরেই এর পরে আত্মঘাতী হন কাজল। সুজাতাবলেন, ‘‘ছেলে আর স্ত্রীকে হারানো দাদা একদম মনমরা হয়ে গিয়েছিল। এর পরেই ওই কাণ্ড ঘটায়। একটা বাজি আমাদের গোটা পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে।’’

Death Fire Cracker
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy