Advertisement
E-Paper

ঘরে অস্বস্তি মদন-কল্যাণ-মহুয়া বিরোধে, বাইরে জারি বিক্ষোভ! আইন কলেজে ধর্ষণের ঘটনা ঘিরে জোড়া চাপে শাসক তৃণমূল

বাইরে ক্রমেই দানা বাঁধছে বিক্ষোভ। আরজি করের ‘পুনরাবৃত্তি’ হবে না তো? এই আশঙ্কাও রয়েছে। তার মধ্যেই ঘরের কোন্দল! কসবার আইন কলেজের ঘটনাকে কেন্দ্র জোড়া চাপে শাসক তৃণমূল।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২৫ ২২:২৭
(বাঁ দিক থেকে) কামারহাটির বিধায়ক মদন মিত্র, শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র।

(বাঁ দিক থেকে) কামারহাটির বিধায়ক মদন মিত্র, শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র। — ফাইল চিত্র।

বাইরে ক্রমেই দানা বাঁধছে বিক্ষোভ। আরজি করের ‘পুনরাবৃত্তি’ হবে না তো? এই আশঙ্কাও রয়েছে। তার মধ্যেই ঘরের কোন্দল! কসবার আইন কলেজের ঘটনাকে কেন্দ্র জোড়া চাপে শাসক তৃণমূল।

কলেজে ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্তদের তৃণমূল যোগ নিয়ে আগেই অস্বস্তিতে পড়েছিল শাসক শিবির। দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি করে সেই অস্বস্তি কমানোর চেষ্টা তারা করেছে বটে। কিন্তু সাংসদ-বিধায়কের ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য এবং দুই সাংসদের ‘কাজিয়া’ প্রকাশ্যে চলে আসায় এ বার বিড়ম্বনায় পড়ে গিয়েছে শাসকদল।

এ দিকে, প্রধান বিরোধী দল বিজেপি তাদের প্রতিবাদ কর্মসূচি জারি রেখেছে রবিবারেও। পথে নেমেছেন শুভেন্দু অধিকারী। মিছিল করেছেন গোলপার্ক থেকে গড়িয়াহাট পর্যন্ত। আগামী ২ জুলাই কসবা অভিযানেরও ডাক দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। এ ছাড়া রবিবার রাজ্যের নানা প্রান্তে সন্ধ্যায় মশাল মিছিল করেছে বিজেপি।

রবিবার ঘটনাস্থলে গিয়েছিল জাতীয় মহিলা কমিশনও। মনে করা হচ্ছে, রাজনৈতিক অস্ত্রে তো বটেই, প্রশাসনিক দিক দিয়েও শাসক তৃণমূলকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে বিজেপি। কসবাকাণ্ডে মহিলা কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ করে। কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মার সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা। এখনও পর্যন্ত কী কী পদক্ষেপ করা হয়েছে, তা তিন দিনের মধ্যে বিস্তারিত রিপোর্ট আকারে কমিশনের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে। রবিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর কমিশনের সদস্যা অর্চনা মজুমদার জানান, নির্যাতিতার বাবার সঙ্গেও তাঁর কথা হয়েছে।

নির্যাতিতার পরিবার জানিয়ে দিয়েছে, তারা এই মুহূর্তে সিবিআই তদন্ত চায় না। পুলিশি তদন্তের উপরেই আস্থা রয়েছে। এ সবের মাঝেও রবিবার নিজেদের মতো করে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। শনিবার রাতেই ঘটনার পুনর্নির্মাণ করেছিলেন তদন্তকারীরা। নির্যাতিতাকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পুলিশ সূত্রে খবর, দু’ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ঘটনার পুনর্নির্মাণ হয়েছে কলেজ ক্যাম্পাসে। এর পর রবিবার নির্যাতিতা এবং অভিযুক্তদের ডিএনএ-র নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ধর্ষণকাণ্ডের তদন্তে শনিবারই একটি বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করেছিল লালবাজার। সেই দলে আরও চার জনকে যুক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে এক জন মহিলা সাব ইনস্পেক্টর।

পুলিশ নিজেরমতো কাজ করলেও, শাসকদলের অন্দরে বিতর্ক থামছেই না। কলেজে ধর্ষণকাণ্ড নিয়ে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলীয় বিধায়ক মদন মিত্রের মন্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হতেই দূরত্ব রচনা করেছিল দল। জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, দুই নেতা যা বলেছেন, তা তাঁদের ব্যক্তিগত মত। দলের অবস্থান নয়। তা নিয়ে ফুঁসে উঠেছিলেন কল্যাণ। পাল্টা সুরও চড়ান সমাজমাধ্যমে। সেই আবহে নাম না করে কল্যাণ-মদনকে আক্রমণ করেছেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘‘ভারতে নারীবিদ্বেষ দলের গণ্ডিতে আটকে নেই। কিন্তু তৃণমূলকে অন্যদের থেকে আলাদা করে একটাই বিষয়, আমরা এই ধরনের বিরক্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদ করি, তা সে যে-ই করুন না কেন।’’

মহুয়ার এই মন্তব্য নিয়েও আবার ফুঁসে উঠেছেন কল্যাণ। তিনি বলেছেন, তিনি নারীবিদ্বেষী নন। কেবল এক জন নারীকেই ঘৃণা করেন। সেই নারী আর কেউ নন, কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া! এ-ও বলেন, ‘‘দেড় মাসের হানিমুন শেষ করে দেশে ফিরেই কি ওঁর আমার পিছনে লাগা শুরু হল? আমি সব নারীকে সম্মান করি, কিন্তু মহুয়া মৈত্রকে ঘৃণা করি। যাঁকে পার্লামেন্টের এথিক্স কমিটি বহিষ্কার করে, তাঁকে ঘৃণাই করি।’’

কল্যাণের সঙ্গে মহুয়ার ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা অবশ্য কারও অজানা নয়। লোকসভাতেও এর আগে প্রকাশ্যে তাঁরা বিতণ্ডায় জড়িয়েছেন। ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে নেতাদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব দলকে অস্বস্তিতে রাখছে, মেনে নিচ্ছেন তৃণমূলের অনেকেই।

মদনকে শো কজ়

কসবার ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য রবিবার মদনকে শো কজ় করেছে তৃণমূল। রবিবার দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী শো কজ়ের চিঠি পাঠিয়েছেন মদনকে। তিন দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, কসবাকাণ্ড নিয়ে মদন যে মন্তব্য করেছেন, তাতে জনসমক্ষে দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই তাঁকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। কসবার সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে ক্যাম্পাসের ভিতরেই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। যা নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়। যে তিন জনের বিরুদ্ধে নির্যাতিতা অভিযোগ তুলেছেন, তাঁরা তৃণমূলের ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) সদস্য। এই ঘটনার পর তৃণমূলের তরফে সাংবাদিক বৈঠক করে জানানো হয়েছিল, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু মদন শনিবার বিতর্কিত মন্তব্য করে বসেন। জানান, ওই ছাত্রীর একা একা কলেজে যাওয়াই উচিত হয়নি। কেন তিনি একা গিয়েছিলেন, প্রশ্ন তোলেন বিধায়ক। রাতেই এই মন্তব্যের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছিল তৃণমূল। বলা হয়েছিল, মদনের মন্তব্য ‘ব্যক্তিগত’। দল তা সমর্থন করে না।

শুভেন্দুদের প্রতিবাদ

রবিবার বিজেপির পক্ষ থেকে ‘কন্যা সুরক্ষা যাত্রা’ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। গোলপার্ক থেকে গড়িয়াহাট পর্যন্ত মশাল মিছিলে অংশ নেন বিজেপি নেতা-কর্মীরা। কর্মসূচি শেষে শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘আর বাড়িতে বসে থাকলে হবে না। পার্কস্ট্রিট, কামদুনি, হাঁসখালি, আরজি কর এবং কসবার ঘটনায় কন্যা সুরক্ষা যাত্রা চলবে।’’ ওই ঘটনার প্রতিবাদে শাসকদল তৃণমূল এবং কলকাতা পুলিশকে একযোগে আক্রমণ করেন বিরোধী দলনেতা। তিনি বলেন, ‘‘এরা কারা? ভাইপো গ্যাং! মমতা হঠাও, কন্যা বাঁচাও। কলকাতা পুলিশ ধর্ষকদের রক্ষাকর্তা। ছাত্রীর মা-বাবাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার? মনোজ বর্মা কোথায় লুকিয়ে দিলেন ছাত্রীকে?’’ ওই কর্মসূচি থেকে বিজেপি জানায়, নির্যাতিতার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে। রবিবার আরজি কর প্রসঙ্গ তুলে নবান্ন অভিযানেরও ডাক দেন বিরোধী দলনেতা। তাঁর কথায়, ‘‘আরজি করের নির্যাতিতার বাবা-মাকে বলব ৯ অগস্ট নবান্ন অভিযানের ডাক দিন। সব নাগরিককে বলব বেরিয়ে আসুন। রাজনীতি সরিয়ে রেখে আমিও যোগ দেব।’’ রবিবার ওই ঘটনার প্রতিবাদে কসবা থানার সামনে বিক্ষোভ দেখায় ‘নারী ঐক্য মঞ্চ’। সেখান থেকে আরজি করের মতো ‘আমরা বিচার চাই’ স্লোগান ওঠে। তারা থানায় একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। তাদের বক্তব্য, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির ২০টি অভিযোগ রয়েছে। সেগুলির নতুন করে তদন্ত শুরু হোক। কসবাকাণ্ডের খিদিরপুরে প্রতিবাদ মিছিল করে কংগ্রেস। গড়িয়াহাট থেকে হাজরা পর্যন্ত অভয়া মঞ্চও মিছিল করেছে। যোগ দিয়েছে নাগরিক মঞ্চও। এই মিছিলে রয়েছে আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম মুখ আসফাকুল্লা নাইয়া। এ ছাড়াও সিনিয়র ডাক্তার তমোনাশ চৌধুরী, পুণ্যব্রত গুণ, সুবর্ণ গোস্বামীকেও দেখা গিয়েছে এই মিছিলে।

হাওড়ায় কলকাতা পুলিশ

কসবার সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে ছাত্রী ধর্ষণে ধৃত ‘পি’কে নিয়ে তাঁর বাড়িতে গিয়েছে পুলিশ। রবিবার সকাল থেকে তাই নিয়ে শোরগোল এলাকায়। বেশ কিছু ক্ষণ ধরে ধৃতের বাড়িতে তল্লাশি চালায় কলকাতা পুলিশের একটি দল। স্থানীয় সূত্রে খবর, কসবার আইন কলেজে গণধর্ষণকাণ্ডে ধৃত ‘পি’ (পুলিশের খাতায় কোডনেম) হাওড়ার চ্যাটার্জিহাট থানার বাসিন্দা। এলাকায় তিনি বেশ পরিচিত। ধর্ষণের ঘটনায় তাঁর নাম জড়ানোর প্রতিবেশীরা অবাক। গত বৃহস্পতিবার ‘পি’ গ্রেফতার হন। তার পর এই প্রথম বার তাঁকে নিয়ে বাড়িতে যায় পুলিশ। জানা যাচ্ছে, বাড়িতে বেশ কিছু ক্ষণ তল্লাশি চলে। বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে পুলিশ। তার পর বেশ কিছু নথি উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছেন তদন্তকারীরা। ধৃত যুবককে নিয়ে পুলিশ যখন গাড়িতে ওঠে ভিড় জমে যায় আশপাশে। বস্তুত, ঘটনার সময়কার সিসিটিভি ফুটেজ হাতে পেয়েছে পুলিশ। সেখানে ধৃত ‘পি’ উপস্থিত ছিলেন বলেই জানা গিয়েছে। প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, ‘পি’ বরাবরই পড়াশোনায় ভাল। হাসিখুশি তরুণ। তাঁর সম্পর্কে এর আগে খারাপ কিছু কেউ শোনেননি। এক প্রতিবেশীর কথায়,‘‘তবে যে অপরাধ ও করেছে বলে অভিযোগ,তা যদি সত্যি হয়, কঠোর শাস্তি হোক। দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’’ ‘পি’-র বাড়ির কেউ কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে রাজি হননি।

TMC BJP Mahua Moitra Kalyan Banerjee Madan Mitra Kasba Rape Case
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy