সেন্ট জন’স চার্চের নির্মাণকাজ তখনও চলছে। পাঁচিল উঠছে চার্চের সীমানা নির্দিষ্ট করতে। সেই পাঁচিল উঁচু হতেই সীমা ঘেঁষা এক বাড়ির একতলার আলো-হাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ির মালকিন মিসেস এলিজ়া ফে আপত্তি জানিয়ে চিঠি লিখলেন গির্জা কর্তৃপক্ষকে। নিজের বাড়ির অবস্থান বোঝাতে লিখলেন, তাঁর বাড়ি চার্চের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, যেখানে আগে ছিল পুরনো পোস্ট অফিস। আঠারো শতকের কলকাতার নথিকার মিসেস ফে-র এই চিঠির সূত্রেই খোলসা হয় হাইকোর্ট লাগোয়া ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের নামরহস্য। ১৭৭৪ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জেনারেল পোস্ট অফিস বছর দশেক কাজ করেছিল এ বাড়ি থেকে। পরে সেখান থেকে বেশ কয়েক জায়গা ঘুরে ১৮৬৮-তে স্থায়ী ভাবে লালদিঘির পশ্চিম পাড়ের গম্বুজশোভিত সাদা বাড়িতে উঠে আসে। পরের বছরগুলি দ্রুত সম্প্রসারণের পাশাপাশি ডাক বিভাগ সাক্ষী বিকেন্দ্রীকরণেরও। ১৮৭৪-এর স্ট্রিট ডিরেক্টরিতে উঠে এসেছে বাগবাজার, বৌবাজারের ওয়েলেসসি স্ট্রিটের মতো এলাকায় ‘পোস্ট অফিস লেটার রিসিভিং হাউস’ স্থাপিত হওয়ার খবর। সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিষেবা জনপ্রিয় হয়ে উঠতেই শহরের নানা জায়গায় বসতে শুরু করে লন্ডনের মতো সুদৃশ্য ‘সুটি’ বা ‘পেনফোল্ড’ লেটারবক্স। তেমন কয়েকটি ডাকবাক্স আজও চোখে পড়ে এ শহরের পুরনো পাড়ায়।
এক সময় শুরু হল প্রতিটি হেড পোস্ট-অফিসকে নির্দিষ্ট জ়োনাল নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করার রীতি। বিশ শতকের প্রথম ভাগে কলকাতার চল্লিশটি ডাকঘরের জ়োনাল-নম্বর মুখস্থ রাখার জন্য ‘পোস্টাফিস-পরিক্রম’ নামে মজার কবিতা লিখেছিলেন নলিনীকান্ত সরকার। নম্বর অনুসারে ডাকঘরের নামের আদ্যক্ষরগুলি সাজিয়ে সংস্কৃত ছন্দের মতো লঘু-গুরু উচ্চারণভেদে পাঠযোগ্য পদ্যটির প্রতিটি চরণে ছিল ষোলোটি মাত্রা। এলাকাভিত্তিক চিঠিপত্রের চাপ সামলাতে শুরু হয় সাব-পোস্ট অফিস বা উপ-ডাকঘর। যেমন, সাহিত্যপত্রিকা অর্চ্চনা-র সুষ্ঠু বিতরণের জন্য ১৯০৬ সালে স্থাপিত হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি লাগোয়া রাস্তায় অর্চনা উপ-ডাকঘর। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাকালে সে পত্রিকার মুদ্রণসংখ্যা ছিল পঁচাত্তর হাজার! খবরকাগজের অফিসের কাজের সুবিধার্থে পত্রিকা কার্যালয়ের সামনেও উপ-ডাকঘর বসতে দেখেছে এ শহর। উত্তর-পূর্ব কলকাতার শ্রীভূমি অঞ্চলে আয়ুর্বেদিক ঔষধ প্রস্তুতকারক সাধনা ঔষধালয় কারখানা স্থাপনের পর সেখানেও বসে উপ-ডাকঘর।
চিঠি লেখার সেই দিন দিয়েছে। তার জায়গা নিয়েছে বৈদ্যুতিন মেসেজ। পার্সেল বিলির ক্ষেত্রেও ডাক পরিষেবার ব্যবসায় ভাগ বসিয়েছে অন্যেরা। গ্রাহক-আনাগোনায় গমগমে বহু ডাকঘরই এখন নিরালা ঠিকানা। আরও নানা কারণে বিভিন্ন উপ-ডাকঘরের সেই সোনালি দিন এখন অতীত। কলকাতা ও শহরতলির পনেরোটি শাখা ডাকঘর মিশে যাবে কাছের অন্য ডাকঘরের সঙ্গে, কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের খবর জানা গেল সম্প্রতি। এ যেন শহরেরই ইতিহাসের একটা পর্বের বিষণ্ণ উপসংহার। ছবিতে শহরের ডাকবাক্স থেকে চিঠি সংগ্রহ করছেন কর্মী, ২০১৪ সালের ছবি।
কুইজ়ে সত্যজিৎ
সত্যজিৎ রায়ের (ছবি) সিনেমা মানেই ডিটেলিং-এর ক্লাসরুম— জানেন আম দর্শক থেকে শুরু করে ওঁর ছবির রসজ্ঞ সমঝদারও। ফেলুদা, শঙ্কু-কাহিনি’সহ ওঁর তাবৎ আখ্যানধর্মী লেখালিখিতেও চরিত্রগুলি, তাঁদের জীবন ও পরিপার্শ্বের খুঁটিনাটি নজর কাড়ে। মূলত সত্যজিতের চলচ্চিত্রবিশ্বকেই উপজীব্য করে গত ২০০২ সাল থেকে ‘রে কুইজ়’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করে আসছে এখন সত্যজিৎ পত্রিকা, সম্পাদক সোমনাথ রায়ের ভাবনা ও রূপায়ণে। অতিমারির দু’টি বছর হয়নি শুধু, তা না হলে প্রতি বছর এই কুইজ়ের আশায় থাকেন শহরের সত্যজিৎপ্রেমীরা। বিংশতিতম ‘রে কুইজ়’ আজ নন্দন ৩-এ বিকেল ৫টা থেকে, চূড়ান্ত পর্ব পরিচালনা করবেন শুভ্রজিৎ দত্ত। এই আনন্দ-আবহে সংবর্ধিত হবেন বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, জন অরণ্য ছবিটির পঞ্চাশে পদার্পণ স্মরণে আলোচনা করবেন শেখর দাশ। থাকবেন সন্দীপ রায় বরুণ চন্দ অলকানন্দা রায় বিভাস চক্রবর্তী সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
এই প্রথম
বাংলা লিটল ম্যাগাজ়িনকে দেশজোড়া আগ্রহী পাঠকের কাছে পৌঁছতে নতুন উদ্যোগ: ‘কাগজওয়ালা ডট ইন’ নামের ই-বিপণন ব্যবস্থা শুরু হল। এখানে বিনামূল্যে নথিভুক্ত হতে পারে যে কোনও লিটল ম্যাগাজ়িন। বাংলা তো বটেই, দেশের যে কোনও জায়গা থেকেই এই উদ্যোগে যোগদান সম্ভব। বাংলার বাইরেও বাংলা ভাষায় নিয়মিত বেরোচ্ছে বহু ছোট পত্রিকা, কিন্তু অনেক সময়েই পাঠকের কাছে পৌঁছতে বেগ পেতে হয় তাদের— বাঁকুড়ার কাগজের খোঁজ পান না জামশেদপুরের পাঠক। সমাধানে উদ্যোগী ওয়েব-পত্রিকা চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। শুধু লিটল ম্যাগাজ়িন বিকিকিনির জন্য এহেন প্রচেষ্টা বাংলায় এই প্রথম।
শহরে মার্ক্স
খুবই প্রাসঙ্গিক। কার্ল মার্ক্স সম্পর্কে বলছিলেন কৌশিক সেন, “মার্ক্সের তত্ত্ব অচল, তাঁর অর্থনীতি সমাজচিন্তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে ইত্যাদি আলোচনা আগেও হয়েছে, পরেও হবে। কিন্তু অদূর অতীতে বা সম্প্রতি যা ঘটে চলেছে এ দেশে বা সারা দুনিয়ায়, তাতে মার্ক্সের মানবিক ভাবনায় ভর করতেই হচ্ছে।” তাঁর নির্দেশনায় ২৯ মে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বিড়লা সভাঘরে স্বপ্নসন্ধানী মঞ্চস্থ করতে চলছে মার্ক্স ইন কলকাতা। ইংরেজি নাটক, মূল নাটকটি হাওয়ার্ড জ়িন-এর লেখা মার্ক্স ইন সোহো, তা থেকে রূপান্তরিত মার্ক্স ইন কলকাতা। মার্ক্সের ভূমিকায় জয়ন্ত কৃপালনী, মেফিস্টোফিলিসের চরিত্রে সৃজিত মুখোপাধ্যায়। এই অভিনয় দিয়েই শুরু হচ্ছে নাট্যদলটির ৩৩তম জন্মদিনের উৎসব। পরের দু’দিন, ৩০ ও ৩১ মে সন্ধ্যায় অ্যাকাডেমি মঞ্চে— হ্যামলেট ও তারায় তারায়।
অন্য রকম
রবিবারের বিকেলে গড়িয়াহাট ট্রাম ডিপো থেকে ট্রাম গড়াল পথে, গন্তব্য শ্যামবাজার। তবে আর পাঁচটা ট্রাম-সফরের চেয়ে মেজাজে আলাদা, এই ট্রামযাত্রা জুড়ে ছিল গান, নাচ, আবৃত্তি, ট্রাম নিয়ে আলোচনা। অথ পথ (সম্পা: হরিসাধন চন্দ্র) সাহিত্যপত্র তাদের সাম্প্রতিক সংখ্যায় মনোযোগের কেন্দ্রে রেখেছে কলকাতার ট্রাম, তার স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ ভাবনা। পত্রিকা প্রকাশ স্মরণীয় করে রাখতেই কর্তৃপক্ষের এই অন্য রকম আয়োজন হয়ে গেল গত ১৮ মে। বিশ্ব উষ্ণায়নের সঙ্কট মনে রেখে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের পরিবর্তে ছিল পদ্মকোরক প্রস্ফুটন: প্রতীকী অবশ্যই, কিন্তু ভাবনাটি দিব্য। নবীন-প্রবীণ সাহিত্যমনস্কের সমাগমে অনুষ্ঠান, পরে তাঁদের নিয়েই ট্রাম চলল ধর্মতলা, কলেজ স্ট্রিট হয়ে। যাত্রীরা পেলেন ট্রামের বিশেষ স্মারক টিকিটও, পত্রিকার নাম লেখা।
ও-পারের সাহিত্য
৮টি উপন্যাস, ১৯টি ছোটগল্প, ২১টি কবিতা, ৪টি নাটক, ১১টি প্রবন্ধ, ৫টি স্মৃতিকথা। রচয়িতারা বাংলাদেশের। প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে বাংলাদেশের সাহিত্য পড়তে হয় এ-পারের পড়ুয়াদের, কেজো পড়াশোনার বাইরে মন লাগে কি? দেশভাগ দুই বাংলার সাহিত্যকেও ভাগ করেছিল; দুই ভৌগোলিক খণ্ডে সাহিত্যের গতি ও প্রকৃতি আলাদা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আবু ইসহাক শহীদুল্লাহ কায়সার সেলিম আলদীন শামসুর রাহমান হাসান আজিজুল হক সেলিনা হোসেন আনিসুজ্জামান-সহ ও-পার বাংলার শ্রেষ্ঠ মন ও কলম থেকে উৎসারিত সাহিত্যকীর্তির আলোচনা নিয়ে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে গত ১৯ মে এক অনুষ্ঠানে প্রকাশিত হল বই বাংলাদেশের সাহিত্য: নির্বাচিত পর্যালোচনা (পুস্তক বিপণি), চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত ও সুজাতা মিত্রের সম্পাদনায়। ছিলেন পল্লব সেনগুপ্ত, শাহ্যাদ ফিরদাউস-সহ বিশিষ্টজন।
কবিকে, শিল্পী
সন্দীপের চর কাব্যগ্রন্থে ‘গোপাল ঘোষের জন্য’ কবিতায় লিখেছিলেন বিষ্ণু দে: “দুরন্ত ঢেউ খাদে খাদে তুমি অক্ষয়যৌবনা/ লাল মাটি তুমি একি তিরিশের খেলা!/ বর্ষণান্তে কার্তিকে আনো পরিণত স্বেচ্ছায়/ উৎরাই আর খাড়াই অশেষ তরঙ্গঘন বেগ—/ ক্ষণে ক্ষণে সংসারে কল্যাণী ক্ষণেকে বা উন্মনা...” শিল্পীকে নিবেদিত কবির কবিতাটি প্রকাশিত সেই কবেই, তবে এই প্রথম বিষ্ণু দে-কে উপহার দেওয়া চিত্রশিল্পী গোপাল ঘোষের ছবি প্রদর্শিত হতে চলেছে কবির পরিবারের সৌজন্যে, দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাস-এর চিত্রলেখা গ্যালারিতে। শুভারম্ভ ২৫ মে রবিবার সন্ধে সাড়ে ৬টায়, আর এক কিংবদন্তি রামকিঙ্কর বেইজের জন্মদিনে— ফি-বছর এই দিনে দেবভাষায় নতুন প্রদর্শনীতে উদ্যাপিত হয় ‘রামকিঙ্কর উৎসব’। এ বার সেই উৎসবেই গোপাল ঘোষের চিত্রপ্রদর্শনী ‘ভিউজ় রিবর্ন ইন ফ্রেমস’ (ছবি), ছুটির দিন বাদে ১৫ জুন অবধি, রোজ দুপুর ২টো থেকে রাত ৮টা।
ছবি ও কথা
এপ্রিলের শেষ থেকেই ডিএজি-র উদ্যোগে আলিপুর মিউজ়িয়মে চলছে চিত্রশিল্পী বালথাজ়ার সলভিন্সের আঁকা চিত্রমালার প্রদর্শনী— যে ছবিতে তিনি তুলে ধরেছেন আঠারো শতক-শেষে কলকাতা ও বাংলার যাপনচিত্র। পালকিবাহক, ভিস্তিওয়ালা (ছবি), তাঁতি, কামার, কুমোর, গায়ক-বাদক মাঝিমাল্লা-সহ নানা পেশার বঙ্গবাসী ধরা পড়েছিলেন তাতে, আর সেই সূত্রেই ফুটে উঠেছিল সে কালের বঙ্গভূমে জাতি-বর্ণ-বর্গের বহুস্তর। প্রদর্শনী চলবে ৫ জুলাই অবধি, এরই সহায়ক ভাবনায় আলোচনা-অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছেন কর্তৃপক্ষ, আগামী ৩০ মে শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় আলিপুর মিউজ়িয়মে বলবেন ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার; ‘ফ্রেমিং কাস্ট’ শিরোনামে ঔপনিবেশিক কালের আদিপর্বে জাতি সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক আলোচনা। থাকবে সলভিন্সের চিত্রপ্রকল্পে সেকালের বঙ্গবাসীর জীবন-জীবিকার বহিঃপ্রকাশ নিয়ে কথালাপও, কিউরেটর জাইলস টিলটসন-এর সঙ্গে।
নব দিশা
যাঁরা মূলত শেখান, তাঁরাই এ বার শিখলেন। কসবার নব বালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের উদ্যোগে গত ১৫ থেকে ১৯ মে একত্র হয়েছিলেন কলকাতার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকেরা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ঘিরে। স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, পরিবহণ, মানবসম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তো বটেই, শিক্ষাক্ষেত্র, গবেষণা ও কর্মসংস্থানের পরিসরেও এআই ক্রমে হয়ে উঠছে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকদের এ নিয়ে অবহিত করতেই এই উদ্যোগ। আমন্ত্রিত বক্তা ও বিশেষজ্ঞদের ভাষণ, আলোচনা, প্রশ্ন-উত্তরে উঠে এল নানা বিষয়: এআই-এর গোড়ার কথা, শিক্ষাব্যবস্থায় তার উপযুক্ত ব্যবহার, অনুবাদে ও গবেষণাপত্র লেখার ক্ষেত্রে এআই-সংক্রান্ত ব্যবহারিক জ্ঞান, এথিক্যাল হ্যাকিং, ডিপফেক ও সাইবার-সুরক্ষা ইত্যাদি। ঝুঁকি আছে, তবে সদিচ্ছা ও সচেতনতা থাকলে আসবে নব দিশাও, মত ওঁদের।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)