জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের বেশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করেছিল প্রথম পর্বের কোভিড। এখন কিন্তু গত বারের থেকেও সংক্রমণের পরিস্থিতি খারাপ। তবু বলব, লড়াইটা চলছে, চলবে।
আমার জীবনের সেই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল গত বছরের মার্চে। মেডিসিন, এমডি চূড়ান্ত বর্ষের শেষ পরীক্ষা লকডাউনে পিছিয়ে গিয়েছিল মাস তিনেক। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাত্র আমি। ওই মধ্যবর্তী সময়েই নেমে পড়েছিলাম কোভিডের চিকিৎসায়। তিন মাস বাড়ি আসিনি। এমডি পরীক্ষায় পাশ করে সিনিয়র রেসিডেন্টের দায়িত্ব পেলাম বেলেঘাটা আইডি-তে। অতিমারির ওই পরিস্থিতিতে আইডি-র মতো হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত হতে পারাটা যে কোনও চিকিৎসকের কাছেই বড় প্রাপ্তি। ফলে, পরিবারের জন্য আতঙ্ক নিয়েও উত্তেজিত ছিলাম।
টানা আট ঘণ্টা পিপিই আর দুটো মাস্ক পরে থেকে খুব কষ্টকর ছিল কাজ করা। তবু বিরক্তি আসেনি। পিপিই পরায় রোগীর শরীরে চ্যানেল করার মতো অভ্যস্ত কাজ করতেও তিন গুণ বেশি সময় লাগত। প্রথম দিকের সেই সব অসুবিধা এখন কাটিয়ে উঠেছি। যা কাটিয়ে উঠতে পারিনি, তা হল মৃত্যু দেখার যন্ত্রণা। সংক্রমণের দ্বিতীয় পর্বে যা আরও ভয়াবহ আকার নিয়েছে। সব রকম চেষ্টা করেও যখন রোগীকে বাঁচানো যায় না, তখন সেই ধাক্কা আমাদের বিচলিত করে। বেশি করে নাড়িয়ে দিয়ে যায় কম বয়সিদের মৃত্যু। সেই ধাক্কা রোজ সামলাতে হয়। সাধারণ মানুষের সচেতনতা যে এই ধাক্কা কমাতে পারে, সেটা আমি এখনও বিশ্বাস করি।
কী ভাবে? কোভিড-বিধি যে মানতেই হবে, সে কথা তো সকলেই বলছেন। সেই সঙ্গে বলব, দ্রুত রোগ নির্ণয়ও খুব জরুরি। প্রতিটি পদক্ষেপই ঠিক মতো করতে হবে। উপসর্গ দেখে সন্দেহ হলেই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। ১৫-১৬ দিন বাড়িতে রাখার কারণে কোনও রোগীর যখন ফাইব্রোসিস হয়ে যায়, যখন তাঁর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ৬০ থেকে ৬৫-তে নেমে যায়, তখন তাঁকে সুস্থ করে তোলাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি কম বয়সি হলেও সঙ্কট কাটানো যায় না। এই অবস্থা যাতে কারও না হয়, রোগী ও তাঁর পরিবারকে সেটা দেখতে হবে।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এই কথাগুলো বলছি। বাবা সুগারের রোগী, মায়ের হাইপ্রেশার এবং কোলেস্টেরল রয়েছে। যাবতীয় বিধি মেনে চলায় এখনও পর্যন্ত তাঁরা সুরক্ষিত। গত ১০ অক্টোবর আমার রিপোর্ট পজ়িটিভ আসে। উপসর্গ বলতে ডায়েরিয়া দিয়ে শুরু। তার পরে গলা ব্যথা আর প্রচণ্ড ক্লান্তি। কী হয়েছে, বুঝে গিয়েছিলাম রিপোর্ট আসার আগেই। প্রতি মুহূর্তে নিজের খেয়াল রাখা, ঘড়ি ধরে ওষুধ খাওয়া, নিঃশ্বাসের হাল্কা ব্যায়াম— সবই করতাম। তবে অক্সিজেন কমেনি। ২১ দিন মতো বাড়িতে আলাদা ছিলাম। এই আলাদা থাকার শুরু জুলাইয়ে আইডি-তে যোগ দিয়েই। বেলঘরিয়ায় আমাদের বাড়ির তিনতলার ছাদের ঘর আর সংলগ্ন শৌচাগারই আমার ঠিকানা। হাসপাতাল থেকে ফিরে উঠে যাই সেখানে। মা ঘরের বাইরে টেবিলে খাবার রেখে যান। মা-বাবা আর বোনকে ভাল করে দেখিনি অনেক দিন! হবু স্ত্রীকেও সামনাসামনি দেখিনি বহু দিন। তিনিও পেশায় ডাক্তার, তাই ভুল বোঝার প্রশ্ন ওঠে না। তবে মানসিক চাপ তৈরি হয়।
অবসর সময়ে নিজের মধ্যে ডুবে থাকি। বাড়িতেই মিনিট কুড়ি ট্রেডমিলে দৌড়ই। ছাদের বাগানে মিনিট পনেরো হাঁটি। ভিডিয়ো গেম খেলি, সিনেমা আর ওয়েব সিরিজ দেখি। ভালবাসি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, সত্যজিৎ রায় আর এখনকার কিছু লেখকের গল্প, উপন্যাস পড়তে।
নিজেকে ভাল রাখার আরও একটা ভরসা ভিটামিন। কোনও ট্যাবলেট নয়। রোগী আর তাঁর পরিবারের কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা। এটাই আমাদের চাগিয়ে রাখে। যখন কোনও পরিজন ফোনে বলেন, ‘ডাক্তারবাবু, ভাবতে পারিনি বাবাকে বা মাকে সুস্থ করে নিয়ে যেতে পারছি। আপনারাই ভগবান’, তখন খুব ইচ্ছে হয়, আবার কারও ভগবান হতে।