শাস্ত্রীয় রূপরেখার বাইরে রথযাত্রার মধ্যে উৎসবের আমেজ ছিল উনিশ শতকের কলকাতায়। স্নানযাত্রা বা দুর্গোৎসবের মতো বাবুদের হুল্লোড় থেকে আলাদা, পারিবারিক উৎসবের পরিসর তৈরি হয়েছিল রথ ঘিরে। সেই আনন্দে ছোটদের অধিকার ছিল পুরো মাত্রায়। চিৎপুরের রাস্তায় দেখা রথের শোভাযাত্রায় হুতোম লক্ষ করেছেন, “ছোট ছোট ছেলেরা বার্নিস-করা জুতো ও সেপাইপেড়ে ঢাকাই ধুতি পরে, কোমরে রুমাল বেঁধে, চুল ফিরিয়ে, চাকর-চাকরানীদের হাত ধরে, পয়নালার ওপর পোদ্দারের দোকানে ও বাজারের বারান্দায় রথ দেখতে দাঁড়িয়েচে।” মেলায় বিক্রি হত মাটির জগন্নাথ, কাঠাল, তালপাতের ভেঁপু, পাখা ও শোলার পাখি। ছেলেদের দেখাদেখি ‘বুড়ো বুড়ো মিন্সে’দের তালপাতের ভেঁপু বাজানোকে হুতোম বাঁকা চোখে দেখলেও, বুঝতে অসুবিধে হয় না, রথের এই উৎসব-মেজাজ তাঁদেরও ফিরিয়ে নিয়ে যেত শৈশবে।
রথের মেলায় হুতোমের দেওয়া শিশুতোষ পণ্যের ফিরিস্তি আরও খানিক লম্বা হয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেখা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পারিবারিক রথযাত্রা দেখে। সেখানে কাঁঠাল, আনারসের মতো ফল ছাড়াও পাওয়া যেত তেলেভাজা, পাঁপড়, ফুলুরি। থাকত গজা, জিলিপি, লুচি, কচুরি, মিঠাই, মিহিদানা, মুড়িমুড়কি, মটরভাজা, চিঁড়েভাজার মতো খাবার। মনিহারি দোকানের খেলনা বাঁশি, কাগজের পুতুল, কাঠির উপর লাফ-দেওয়া হনুমান, কট্কটে ব্যাঙ কিনতে ভিড় জমাত ছোটরা। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য আসর বসত পুতুলনাচের, থাকত নানা রকমের সঙ। ‘আহ্লাদে পুতুল’ নামে এক ধরনের সঙের হাত-পা নাড়া ও হাসিতে মুগ্ধ হত খুদেরা।
সিমুলিয়া কাঁসারিপাড়ার তারকনাথ প্রামাণিকের বাড়ির পিতলের রথের কথা তো জানে সবাই। কিন্তু সেই বড় রথ তো আর বাড়ির শিশুরা টেনে নিয়ে যেতে পারবে না, তাই তাদের রথযাত্রায় অংশগ্রহণে উৎসাহ ও আনন্দ দিতে চার ফুট উঁচু, ছোট একটি পিতলের রথ বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার বয়সও নব্বই ছুঁই-ছুঁই।
বর্ষাকাল আর রথ ঘিরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলার স্মৃতি, “আমরা বর্ষাকালে রথের সময়ে তালপাতার ভেঁপু কিনে বাজাতুম; আর টিনের রথে মাটির জগন্নাথ চাপিয়ে টানতুম, রথের চাকা শব্দ দিত ঝন্ ঝন্; যেন সেতার নূপুর সব একসঙ্গে বাজছে।” রথের হাত ধরে অনেক সময় আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তেমনই এক দুর্যোগে হারিয়ে গিয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারানী। এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটত সে কালে— পুরনো খবরকাগজে মেলে হারিয়ে যাওয়া শিশুর খবর চেয়ে উদ্বিগ্ন আত্মীয়দের বিজ্ঞাপন।
সময়ের সঙ্গে বদলেছে রথের উপচার। পুরনো খেলনা আর আমোদের জায়গা নিয়েছে নবযুগের বিনোদন। তবে শিশুদের আনন্দ আছে আগের মতোই। গতকাল বিকেলেও দেখা গেল, ছোট্ট হাতগুলি পথচলতি মানুষের হাতে জগন্নাথের প্রসাদ তুলে দিচ্ছে। জিলিপি-পাঁপড়ভাজার গন্ধের পাশে শিশুহাতে বাড়িয়ে দেওয়া ওই নকুলদানা-বাতাসায় আসলে মিশে আছে রথের চিরন্তন বাঙালিয়ানা।
ফরাসি অনুবাদে
তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায়, ‘বহুরূপী’র প্রযোজনায় (ছবি) রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর-এর নাট্যস্মৃতি আজও অমলিন। তার অনেক আগে, রবীন্দ্রনাথের জীবনকালেই যুদ্ধময় ইউরোপে সাড়া ফেলেছিল ডাকঘর, ১৯১৪-তে দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের ইংরেজি অনুবাদ থেকে মঞ্চায়িত হয় প্রথম মহাযুদ্ধের লন্ডনে বেলজিয়ান শরণার্থীদের জন্য। পরের বছর ফরাসিতে ডাকঘর অনুবাদ করেন অঁদ্রে জিদ, ওই ইংরেজি অনুবাদ থেকেই। ফরাসি গবেষক, রেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাবিয়াঁ শার্তিয়ে-র গবেষণার বিষয় ফ্রান্সে রবীন্দ্র-প্রভাব, সেই সূত্রেই সম্প্রতি ডাকঘর-এর যুগোপযোগী ফরাসি অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি দেখেন, জিদের অনুবাদে বাদ পড়ে গিয়েছে দু’টি গোটা পাতা, অমল ও ঠাকুরদার দীর্ঘ সংলাপ। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ় দ্যু বাঙ্গাল ও বিশ্বভারতীর যৌথ উদ্যোগে আগামী অগস্টে বিশ্বভারতীর শিক্ষক নিপুণ নূতন ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কর্মশালা করবেন ফাবিয়েঁ; বাংলা, ইংরেজি ও ফরাসির ত্র্যহস্পর্শে রূপ পাবে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ফরাসি অনুবাদটি: অমল এ লা লেত্র দ্যু রোয়া। প্রকাশ করবে ‘সম্পর্ক’।
মনে রেখে
এ শহরেই আছেন কিছু মানুষ, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও পত্রিকাও, হিস্প্যানিক ভাষা-সংস্কৃতি চর্চা যাঁদের ব্রত। তেমনই একটি হল এল কামিনো, ইন্দো-স্প্যানিশ অ্যাকাডেমির ত্রিভাষিক পত্রিকা। বাংলা ইংরেজি ও স্প্যানিশে লেখা বেরোয় সেখানে, ২০১৭ থেকে সম্পাদনা করছেন সৌম্যকান্তি রায়। সাম্প্রতিক সংখ্যাটি নিবেদিত ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার স্মরণে। রয়েছে প্রেম ও বিরহের কবি, জীবন-নাট্যকার লোরকার কৃতি ও স্মৃতি, ওঁর কবিতার অনুবাদ, রবীন্দ্র-অনুরাগ নিয়ে লেখা। “কবিতা অনুরাগী চায় না, প্রেমিক চায়,” লিখেছিলেন লোরকা। রবীন্দ্রনাথের স্পেনে যাওয়া হয়নি, লোরকাও কখনও আসেননি ভারতে। কলকাতা কিন্তু ভোলেনি তাঁকে।
আবহমান
বাংলা গানের ধারায় কী ভাবে তৈরি হয়েছে আবহমানের ধারণা? শেষ পর্যন্ত কী করেই বা তা পৌঁছেছে রবীন্দ্রগানে? আবার, আবহমানের মধ্যেই বা কী ভাবে নিজেকে আবিষ্কার করছেন রবীন্দ্রনাথ? ইতিহাসের মধ্যে সতত রয়েছে আবহমানের স্বর, রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে আত্ম-অনুসন্ধানের পথে সেই আবহমানের মধ্যে ঢুকে পড়ছেন; ইতিহাসের আবহমান মিশে যাচ্ছে আপনাকে জানার ভিতরে। রবীন্দ্রনাথের গানের শরীরও নির্মিত হয়েছে একই প্রক্রিয়ায়, তার অন্তরে বেজে চলেছে আবহমান বাংলা গানের স্বর। ‘ইন্দিরা’ গোষ্ঠী আয়োজিত ‘সুভাষ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা’র দশম বর্ষে এ নিয়েই বলবেন সঙ্গীতবেত্তা-গবেষক সর্বানন্দ চৌধুরী, আজ সন্ধে ৬টায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্দুমতী সভাগৃহে।
শুভারম্ভ
মন দিয়ে পারফর্মিং আর্ট চর্চা করে, এমন প্রতিষ্ঠান কম নয় কলকাতায়। সেই ভিড়েও নজর কাড়ে ‘ছবি ও ঘর ইন্ডিয়া আর্ট ফাউন্ডেশন’-এর অধীনে ‘সালংকারা’র মতো নৃত্যশিক্ষা ও মঞ্চনাট্য চর্চা কেন্দ্র। তার হাত ধরেই জীবনের মাঝপথে, সায়াহ্নে বা দীর্ঘ বিরতির পর অনেকেই ফিরেছেন নাচের কাছে: কেউ চিকিৎসক, অধ্যাপক, কেউ গৃহিণী বা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী। নাচ হয়ে উঠেছে তাঁদের নিজস্ব যাপনের ভাষা। প্রথম দ্বিধা, টলমল পা, প্রথম বার মুদ্রা ঠিক হওয়ার আনন্দ মিশে সেই যাত্রায়। এই আনন্দকেই আরও এক ধাপ এগিয়ে এ বার ওঁরা প্রকাশ করছেন ব্যতিক্রমী এক পারফর্মিং আর্ট পত্রিকা, কথা সালংকারা। প্রথম সংখ্যার বিষয় রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা। কেয়াতলা লেনে ছবি ও ঘর আর্ট গ্যালারিতে রবিবার বিকেল ৫টায় আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা।
ব্রাজিলের ছবি
এর আগে তারা আয়োজন করেছে ক্রোয়েশিয়া, জার্মানির ছবির উৎসব। এ বার ব্রাজিলের সাম্প্রতিক কিছু কাহিনিচিত্রের সম্ভার, ভবানীপুর ফিল্ম সোসাইটি-র উদ্যোগে। আজ ও কাল, ২৮-২৯ জুন নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে চারটি ছবি: দ্য হাউস অব স্যান্ড, ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন রিয়ো, এস্তোমাগো এবং রোমিয়ো অ্যান্ড জুলিয়েট গেট ম্যারেড। রোম্যান্স থেকে ড্রামা, কমেডি আর কৃষ্ণকৌতুক, অপরাধজগৎ, ফুটবলপ্রেম থেকে পারিবারিক সম্পর্ক— সবই উঠে এসেছে ছবিগুলিতে। এ বারের অস্কারের মঞ্চে সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়নের দৌড়ে থাকা ফার্নান্দা তোরেস ও তাঁর মেয়ে অভিনয় করেছেন প্রথম ছবিটিতে, পর্দায় মা-মেয়ের চরিত্রেই! আজ দুপুর সাড়ে ৩টেয় আর রবিবার বিকেল সাড়ে ৪টে থেকে শুরু। সহযোগিতায় দিল্লির ব্রাজিলীয় দূতাবাস।
সোনালি অতীত
২০১৫ সালে পার্ক স্ট্রিটের একটি আর্ট গ্যালারিতে জড়ো হয়েছিলেন এ শহরের শিল্পরসিক, সিনেমাপ্রেমী মানুষেরা, অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের মহাযাত্রার নানা মাইলফলক: একগুচ্ছ সিনেমা-স্মারকে ধরা। ‘আর্ট ইন’ ও ‘সেন্সরিয়াম’-এর একত্র উদ্যোগে সেই প্রদর্শনী মন কেড়েছিল কলকাতার। দশ বছর পর আবারও ফিরছে সেই আয়োজন, ‘সালাম সিনেমা’র দ্বিতীয় সংস্করণ, আইসিসিআর-এ। শমীক দে ও শৌনক চক্রবর্তীর সযত্ন কিউরেশনে বাংলা ও ‘বম্বে’র সোনালি অতীতের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য: উমরাও জান, অরণ্যের দিনরাত্রি-সহ পঞ্চাশের কাছাকাছি ছবির ‘অরিজিনাল’ ফিল্ম পোস্টার, অর্ধশতাধিক লবি-কার্ড, দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র (ছবিতে বিমল রায়ের পরিণীতা ছবির দৃশ্য, আলোকচিত্রে)-সহ শতাধিক সিনেমা-স্মারকে। রাজ কপূর মহম্মদ রফি রাজ খোসলা সলিল চৌধুরী অরুন্ধতী দেবী তপন সিংহ ও ঋত্বিক ঘটককে স্মরণ করা হয়েছে শতবর্ষে। শুরু হল গতকাল ২৭ জুন, চলবে ২ জুলাই পর্যন্ত, ৩টে-৮টা।
আকারের মহাযাত্রা
জগৎটা আকারের মহাযাত্রা, লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই আকারকেই দেখতে পেয়ে, তার মুহূর্তটুকু ক্যামেরায় ধারণ করেন প্রদীপ দত্ত, পরক্ষণেই তো সে পাল্টে যাবে নতুন রূপে! বটপাকুড়ের ফেনা-তে শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন তাঁর ছবি ও শিল্পিত মনটি নিয়ে। শহরের রাস্তায় বাসে উঠতে গিয়ে দোমড়ানো কাগজের টুকরো দেখে মনে হয়েছিল যেন এক ক্ষীণতনু মানুষ, তুলে নিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে সবুজ ঘাসের জমিতে সেটি ও সঙ্গে একটি ফুল রেখে ক্যামেরায় ছবি তুলতে সে হয়ে উঠল ব্যঞ্জনাময় (ছবি)। বিশিষ্ট আলোকচিত্রী প্রদীপ দত্তের ছবির প্রদর্শনী ‘আ ভয়েজ অব ফর্ম’ ২৭ জুন থেকে ৩ জুলাই অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সাউথ গ্যালারিতে, ১২টা-৮টা। সঙ্গে রোজ সন্ধে ৭টায় সোমেশ্বর ভৌমিকের তথ্যচিত্র হিডন ইমেজেস।
সসম্মানে
পূর্ব মেদিনীপুরের দাদন পাত্রবাড় এখন বিস্মৃতপ্রায়, মন্দারমণি নামটাই লোকমুখে ফেরে। সেখান থেকে কয়েক মাইল দূরের গ্রামে বড় হওয়া, খালিপায়ে ফ্রক পরে স্কুলে যাওয়া ছোট্ট মেয়েটিই উত্তরকালে বাংলা সাহিত্যের লব্ধপ্রতিষ্ঠ গবেষক-অধ্যাপক, প্রাচীন ও মধ্যযুগ বিশারদ সত্যবতী গিরি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তন শিক্ষক, নানা প্রতিষ্ঠানে পঠনপাঠন ও প্রশাসনিক কাজে যুক্ত আজও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদক, সাহিত্য অকাদেমি ভাষা-সম্মান, তারাশঙ্কর পুরস্কার, সহজিয়া সম্মান, ঘনরাম অ্যাকাডেমি জীবনকৃতি সম্মান, নাগপুর প্রবাসী বাঙালি সংগঠন প্রদত্ত সম্মান: সম্মাননার তালিকাটি সুদীর্ঘ। তাঁর ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে গত ৮ জুন কে কে দাস কলেজে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাল অধ্যাপক সত্যবতী গিরি সম্মাননা-গ্রন্থ প্রকাশ কমিটি; অগ্রজ, অনুজ, সহকর্মী ও গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী-সমাগমে— কথায়, গানে, আনন্দ-আবহে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)