Advertisement
E-Paper

‘ক্যানসার তো কী? তিন জনের আসনে চার জন চেপে বসুন!’

ভয়টা অবশ্য শুরু হয়েছিল অত ভোরেও টিকিট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন দেখে। সেখানে যাত্রীদের মধ্যে ছ’ফুট দূরত্ব বজায় রাখা তো দূর, ছ’ইঞ্চির দূরত্বও ছিল না।

সত্যনারায়ণ পণ্ডিত (রেলযাত্রী)

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২০ ০২:৫৯
থিকথিকে: বিধাননগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তিলধারণের জায়গা নেই। বুধবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

থিকথিকে: বিধাননগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তিলধারণের জায়গা নেই। বুধবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

আমার স্ত্রী শিপ্রা থার্ড স্টেজের স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। বার বার ঘুরেও হাসপাতাল থেকে কেমোথেরাপির তারিখ পাইনি। অনেক চেষ্টার পরে আজ, বুধবার যেতে বলেছিল হাসপাতাল। লকডাউনের মধ্যে দু’বার কোনওমতে গিয়েছি। ফের গাড়ি ভাড়া করে কলকাতায় যাওয়ার ক্ষমতা নেই। মনে হয়েছিল, ট্রেন চালু হওয়ার প্রথম দিনে ভোর ছ’টা পাঁচের রানাঘাট লোকালে তেমন ভিড় হবে না। কিন্তু কল্যাণী স্টেশন পেরোতেই ভিড় যে এমন আগল ভাঙা চেহারা নেবে, বুঝতে পারিনি। এখন অপরাধবোধে ভুগছি। মনে হচ্ছে, জেনেশুনে স্ত্রীকে বিপদে ফেললাম না তো!

ভয়টা অবশ্য শুরু হয়েছিল অত ভোরেও টিকিট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন দেখে। সেখানে যাত্রীদের মধ্যে ছ’ফুট দূরত্ব বজায় রাখা তো দূর, ছ’ইঞ্চির দূরত্বও ছিল না। সকলেরই যেন প্রবল তাড়া। যেন অন্যের ঘাড়ের উপর দিয়ে গিয়ে আগে টিকিট কাটবেন! লাইন ভাঙায় মাস্ক নামিয়ে প্রবল ঝগড়াও শুরু করলেন কেউ কেউ। কিন্তু ট্রেনে উঠে খানিক স্বস্তি পেয়েছিলাম। সে রকম ভিড় ছিল না। তিন জনের আসনের মাঝের জায়গাটি ছেড়ে আমি আর শিপ্রা বসলাম। পায়রাডাঙা থেকে মদনপুর পর্যন্ত কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু কল্যাণী ঢুকতেই সে কী অবস্থা!

হুড়মুড়িয়ে ওঠা এক ব্যক্তি কড়া সুরে বললেন, ‘‘ও সব দূরে দূরে বসা হবে না। ব্যাগ নামান। চেপে বসুন।’’ আর এক যাত্রী উঠেই তর্ক জুড়ে দিলেন। বললেন, ‘‘ক্যানসার আক্রান্তকে নিয়ে বেরিয়েছেন কেন! অত ভয় থাকলে গাড়ি ভাড়া করে কলকাতায় যান। ট্রেন আর বিমানের পার্থক্য তো বুঝবেন!’’ প্রশ্ন করলাম, ‘‘ক্যানসার না হলেও কি এ ভাবে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে যাওয়ার কথা?’’ কেউই শুনলেন না। সকলেই যখন মেনে নিলেন, তখন দুই বয়স্ক আর কত লড়ব!

আরও পডুন: এ বার বাজি ফাট‌লে ফুসফুসের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী

নৈহাটি স্টেশন আসতেই ভিড় আরও বাড়ল। পরের এক ঘণ্টায় কামরার অবস্থা দেখে সত্যিই বুঝতে পারিনি, করোনা পরিস্থিতি চলছে না স্বাভাবিক সময়েই ট্রেনে উঠেছি! এক সময়ে অবস্থা এমন হল যে, আসনে বসে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের ভিড়ে পা রাখার জায়গাও পাচ্ছিলাম না। শ্যামনগর থেকে কয়েক জনের একটি দল আবার উঠেই ফরমান জারি করলেন, ‘‘ক্যানসার তো কী? তিন জনের আসনে চার জন চেপে বসুন!’’

আরও পডুন: আত্মঘাতীই হন প্রৌঢ়, অনুমান পুলিশের​

এ বারও কোনও যুক্তি দিয়েই পেরে ওঠা গেল না। তত ক্ষণে মাস্ক নামিয়ে কেউ গল্প শুরু করেছেন পাশের জনের সঙ্গে। কেউ এক কানে মাস্ক ঝুলিয়ে ফোনে কথা বলে চলেছেন তারস্বরে। মাস্ক পকেটে ভরে ব্যাগ থেকে লেবু, কলা বা মুড়ি বার করে খাওয়াও চলছে আগের মতোই। গোল হয়ে তাস খেলারও বিরাম নেই। দুই প্রবীণের লকডাউন পরবর্তী প্রথম দিনের রেল-যাত্রার এমনই অভিজ্ঞতা হল বাড়ি ফেরার সময়েও।

যদিও যে কাজের জন্য এই বিপদ মাথায় নিয়ে এ দিন কলকাতা গিয়েছিলাম, তা হয়নি। বিধাননগর স্টেশনে নেমে নিউ টাউনের যে হাসপাতালে শিপ্রাকে দেখাচ্ছি সেখানেই পৌঁছই। বেশ কিছু ক্ষণ অপেক্ষার পরে জানতে পারলাম, এ দিন চিকিৎসক আসবেন না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে গেল। হাসপাতাল থেকে বৃহস্পতিবার আবার যেতে বলা হয়েছে। আমি একটি ছোট সংস্থার চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। মেয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করেও এখনও চাকরি পায়নি। গাড়ি ভাড়া করে স্ত্রীকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার সত্যিই অবস্থা নেই। বিপদ মাথায় নিয়েই আবার ভোরের ট্রেন ধরতে হবে। শুধু ভাবছি, আমি আর শিপ্রা যতই সাবধান হই, অন্যেরা না বুঝলে কি বিপদ এড়াতে পারব?

Cancer patient Local Train Indian Railways Gathering Social Distamcing Coronavirus
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy