Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পাল্টেছে হাওড়া, শিয়ালদহ-কলকাতা তিমিরেই

এই শহরে স্টেশন চত্বরের পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিনিয়তই অভিযোগ তোলেন যাত্রীরা। প্রশাসনের তরফেও বহু বার সেই অবস্থার পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মিলেছে। কিন্তু কেমন হয়েছে সেই পরিবর্তন? হাওড়া, শিয়ালদহ ও কলকাতা স্টেশন ঘুরে দেখলেন আনন্দবাজারের প্রতিনিধিরা। এই শহরে স্টেশন চত্বরের পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিনিয়তই অভিযোগ তোলেন যাত্রীরা। প্রশাসনের তরফেও বহু বার সেই অবস্থার পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মিলেছে। কিন্তু কেমন হয়েছে সেই পরিবর্তন? হাওড়া, শিয়ালদহ ও কলকাতা স্টেশন ঘুরে দেখলেন আনন্দবাজারের প্রতিনিধিরা।

দেবাশিস দাশ, শান্তনু ঘোষ ও আর্যভট্ট খান
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৪ ০০:৫৩
Share: Save:

পরিবর্তনের ছবি... হাওড়া স্টেশন

রাত ১১টা ৩৫

কর্মক্ষেত্র কেরল থেকে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছেছেন নিউ জলপাইগুড়ির বাসিন্দা চার যুবক। যাবেন শিয়ালদহ স্টেশনে। মালপত্র নিয়ে তাঁরা এসে দাঁড়ালেন স্টেশনের বাইরে, জি আর রোডে। সুনসান রাস্তায় তাঁদের বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন পাশের কিয়স্কে বসে থাকা এক ট্রাফিক পুলিশ অফিসার। যুবকদের থেকে সব কিছু শুনে তিনি তাঁদের পরামর্শ দিলেন হাওড়া ব্রিজের মুখে যাওয়ার জন্য। সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই চার যুবক শিয়ালদহ যাওয়ার একটি সরকারি বাস পেয়ে গেলেন।

রাত ১২টা। হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছলেন কসবার বীরেন রায়। চাকরি সূত্রে বাইরে থাকেন। স্ত্রী, এক বছরের শিশুপুত্র ও মালপত্র নিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে এ দিক-ও দিক ঘুরছিলেন। তখনই এগিয়ে এলেন এক ট্রাফিক পুলিশ। তাঁদের নিয়ে গেলেন প্রিপেড ট্যাক্সির লাইনে। সেখান থেকেই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ট্যাক্সি পেয়ে গেলেন বীরেনবাবু। বললেন, “বছর তিনেক বাদে হাওড়া স্টেশনে এলাম। কিন্তু এই বদল ভাবাই যায় না।”

বছর দু’য়েক আগে হাওড়া স্টেশন চত্বরের এই ছবি ভাবতেই পারতেন না যাত্রীরা। তাই অনেকেই বলে যান, ‘এ ছবি একেবারে অচেনা।’ আগে রাত ১০টা বাজলেই রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যেত পুলিশ। চলত কয়েকটি মাত্র বেসরকারি বাস। সরকারি বাসের দেখা মিলত কালেভদ্রে। আর সেই কারণেই ট্যাক্সির দৌরাত্ম্যের কাছে নতি স্বীকার করতে হত দূরপাল্লার ট্রেন থেকে নামা যাত্রীদের। কিন্তু এখন গভীর রাত পর্যন্ত হাওড়া ব্রিজ ও স্টেশন চত্বরে ঘুরে বেড়ায় ট্রাফিক পুলিশ। বেশি রাতেও পাওয়া যায় বাস। হাওড়া সিটি পুলিশের এক কর্তার কথায়, “পুলিশ প্রি-পেড ট্যাক্সি বুথ চালানোর দায়িত্ব নেওয়ার পরেই ফাইল ট্যাক্সির রমরমাও বন্ধ হয়েছে।”

নিয়ম ভাঙার খেলা... শিয়ালদহ স্টেশন

রাত সাড়ে ৮টা

আত্মীয়দের ট্রেনে তুলতে এসেছিলেন কাঁকুড়গাছির সুমিত সরকার। স্টেশন থেকে বেরিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন প্রিপেড ট্যাক্সি বুথের দিকে। সেখানে তখন যাত্রীদের লম্বা লাইন। কিন্তু একটিও ট্যাক্সি নেই। তবে ঠিক সেই লাইনের পাশেই ফাঁকা জায়গায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্যাক্সি। সে সব ট্যাক্সিতে উঠছেন অনেক যাত্রী। সুমিতবাবুও এগিয়ে গেলেন সে দিকেই। ট্যাক্সি পেতে দেরি হল না। তবে কে কোন ট্যাক্সিতে উঠবেন, তার পুরোটাই তদারকি করতে দেখা গেল জিআরপি-কে।

রাত সাড়ে ৯টা। স্টেশন সংলগ্ন রেল হাসপাতালের সামনের রাস্তায় লাগানো ‘নো-পার্কিং’ বোর্ড। কিন্তু তার সামনের লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্যাক্সি। কামালগাজির বাসিন্দা স্বরূপ নাগ সেখান থেকে ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে ফিরে এলেন। তিনি বললেন, “বেশি দূরে মিটারে গেলে খালি ফিরতে হবে। তাই কোনও ট্যাক্সি যেতে রাজি হল না।” যদিও পুরো ঘটনাটি ঘটল ট্রাফিক পুলিশের সামনে।

রাত সওয়া ১০টা: শিয়ালদহ আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে ৬-৭টি ট্যাক্সি। কিন্তু কোনওটাই মিটারে যাবে না। কেননা, মাথা পিছু ৫০-৭০ টাকা ভাড়ায় ওই ট্যাক্সিগুলি হাওড়া-শালিমার পর্যন্ত শাটলে যাচ্ছে। এক চালকের কথায়, “মাত্র ১০ টাকা দিলেই রাস্তায় দাঁড়ানো যায়। আর স্টেশনের ভিতরে ঢুকলে ২০-২৫ টাকা দিতে হয়। সঙ্গে সংগঠনের চাঁদা। তাই রাস্তাতেই দাঁড়াই।”

ট্যাক্সিচালকেরাই জানালেন, স্টেশন চত্বরের প্রিপেড লাইনের পাশেই রয়েছে ট্যাক্সির ‘জিআরপি লাইন’। শিয়ালদহ আদালতের সামনে থেকে স্টেশন চত্বরে যে সমস্ত ট্যাক্সি ঢুকছে, সেগুলি প্রিপেড না জিআরপি, কোন লাইনে যাবে, তা ঠিক করে দেন ওই রেল পুলিশের কর্মীরাই।

এক ট্যাক্সিচালক বললেন, “প্রিপেড লাইনে ঢুকলে যা ভাড়া, তা-ই নিতে হয়। কিন্তু ২০-২৫ টাকার বিনিময়ে জিআরপি লাইনে ঢুকতে পারলে যাত্রীদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দরদাম করা যায়।”

তবে শিয়ালদহ ডিভিশনের এসআরপি উৎপল নস্করের বক্তব্য: “এমনটা কোনও মতেই হওয়ার কথা নয়। আমাদের শুধু ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করার কাজ। বিষয়টি খোঁজ নেব।”

আঁধার পথের যাত্রী... কলকাতা স্টেশন

রাত ৯টা ৪৫

রাত যত বাড়ছে, বদলে যাচ্ছে স্টেশন চত্বরের ছবিটাও। কমে এসেছে ট্যাক্সির সংখ্যাও। সেই সময়েই স্টেশনে এসে ঢুকলো হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস। একে বাস নেই। ট্যাক্সি যাচ্ছে মোটা ভাড়ার বিনিময়ে। আবার অটো থাকলেও তা রিজার্ভ করে যেতে হবে। এমন অবস্থায় বেজায় সমস্যায় পড়লেন খিদিরপুরের বাসিন্দা নাসিম আলম। তিনি বললেন, “এত ভাড়া দিয়ে ট্যাক্সিতে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তাই স্ত্রী-পুত্র নিয়ে অন্ধকার রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হবে।”

রাত ১০টা ৫: ট্রেন থেকে নেমে বেশি ভাড়ার ট্যাক্সি যাঁরা ধরতে পারলেন না অগত্যা তাঁরা হাঁটতে শুরু করলেন অন্ধকার রাস্তা ধরেই। স্টেশন থেকে আরজিকর পর্যন্ত প্রায় আধ কিলোমিটার রাস্তায় নেই পর্যাপ্ত আলো। রাস্তার ধারে ঝোপঝাড়। যাত্রীদের অভিযোগ, গভীর রাতে দারভাঙা এক্সপ্রেস, মিথিলা এক্সপ্রেস ঢোকে স্টেশনে। সমস্যাটা বাড়ে তখনই। গভীর রাতে ট্যাক্সিচালকদের কথা মেনে না নিলে অগত্যা অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে বড় রাস্তায় যাওয়া, নয়তো স্টেশনে রাত কাটানো ছাড়া কোনও গতি থাকে না।

যাত্রীদের অভিযোগ, রাত বাড়লেই বিভিন্ন রকম নৈরাজ্য শুরু হয় কলকাতা স্টেশন চত্বরে। সন্ধে সাতটার পরে কোনও বাস চলে না। প্রিপেড স্ট্যান্ডে ট্যাক্সি থাকে না বললেই চলে। ফলে স্টেশন চত্বরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ট্যাক্সির চালকদের মর্জিমতো চাওয়া ভাড়ায় যাঁরা গন্তব্যে যেতে রাজি না হন তাঁদের অগত্যা অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে পৌঁছতে হয় আরজিকর হাসপাতালের সামনের রাস্তায়। সেখান গেলে তবেই মিলবে বাস।

ঘোটা বিষয়টি শুনে রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “পুলিশ টেন্ডার ডেকে হাওড়া স্টেশনে প্রিপেড বুথ চালায়। তাই ওখানে ট্যাক্সির সমস্যা নেই। কিন্তু শিয়ালদহ ও কলকাতায় তা নয়। পুলিশকে অনুরোধ করেছি, ওই দুই স্টেশনে কোন সময়ে বেশি বাস দরকার এবং কখন কম বাস দরকার, তার একটা সময়সারণি আমাদের দিতে। পাশাপাশি, ট্যাক্সির দৌরাত্ম্যের শিকার হলে যাত্রীরা দয়া করে ১০৭৩-তে জানান। পুলিশের সঙ্গেও কথা বলব।”

ছবি: বিশ্বনাথ বণিক, স্বাতী চক্রবর্তী ও দীপঙ্কর মজুমদার)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE