Advertisement
২১ মে ২০২৪
হবে জয়
Coronavirus

করোনা-সঙ্কটে মনুষ্যত্বের বোধন

আতঙ্কে মজুতদারির প্রবণতাই শেষ কথা নয়। কানাকড়ি সম্বল করে অন্নদানে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগিদও বিস্তর।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতমাতা’র অনুসরণে। অঙ্কন: অমিতাভ চন্দ্র

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতমাতা’র অনুসরণে। অঙ্কন: অমিতাভ চন্দ্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২০ ০৪:১০
Share: Save:

নুন-মাখা কুল, কাচের চুড়ি আর পুতুলের শৈশবের রং পাল্টে গিয়েছে রাতারাতি। লক্ষ্মীর ভাঁড়ের সঞ্চয়টুকুর জন্য মরমে মরে যাচ্ছে দুই বালিকা। তারা যে টিভিতে বুভুক্ষু শ্রমিকদের দেখেছে। জেনেছে, গাঁয়ের কত চাচা, নানির ঘরেও হাঁড়ি চড়ছে না। অতএব পঞ্চম শ্রেণির সাবিকুন্নাহার বেগম, তৃতীয় শ্রেণির নাজরিন বেগম সে দিন কোঁচড়ে আড়াইশো টাকা খুচরো নিয়ে সটান দাদার সাইকেলে বিডিও-র অফিসে চলল। মাটির ভাঁড় ভেঙে টিফিনের পয়সা থেকে তিলে তিলে জমানো পুঁজি উপুড় করতে মরিয়া দুই কন্যে।

মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম ব্লকের এ ছবিটাই দেশে করোনা-যুদ্ধে বাংলার সংহতির প্রতীক হতে পারে! কিংবা, বর্ধমানের অণ্ডালের দক্ষিণখণ্ডে আন্নারানি মণ্ডলের ছবিটা। আন্নারানি ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী, শরীর মুড়তে পারেন না। প্রাথমিক স্কুলের চাকরিতে অবসর নিয়েছেন তিন বছর আগে। শরীরটা টেনে হিঁচড়ে বেরিয়ে লাঠি হাতে লাখ টাকার চাল, তেল, আলু কিনেছেন। অভুক্ত গ্রামের শ’পাঁচেক পরিবার। “ওরা খেলে জমানো টাকার সদগতি হবে। নইলে আমার গলা দিয়েও ভাত নামবে না,” বলছেন তিনি।

করোনা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর ভাঁড়ারও ভরে আছে কত টুকরোটাকরা সামান্য দানের অসামান্যতায়। কল্যাণীর ক্লাস সিক্স পূর্ণাশা দাসের বাড়িতে ঢুকে অভিভূত বিডিও সাহেব। জমানো আট হাজার টাকার সবটা উজাড় করে দিচ্ছে নিঃস্বার্থ কৈশোর। ইলামবাজারে একদা প্রাথমিক স্কুলের মাস্টারমশাই অশীতিপর মন্মথনাথ চট্টোপাধ্যায় কিংবা বেলপাহাড়ির প্রাথমিক স্কুলের হেডস্যার স্নেহাশিস দাসও এ যুদ্ধের সৈনিক। দরিদ্রতমদের পাশে দাঁড়াতে পেনশনের টাকা, মাইনেয় হাত দিচ্ছেন। কলকাতার দত্তবাগানে বাসস্ট্যান্ডে আটকে পড়া বেশ কয়েকটি বেসরকারি বাসরুটের খালাসিদের ভরসা স্থানীয় বাসিন্দারাই। লালগোলার জনা সাতেক ছাত্র পুরনো বাসস্ট্যান্ডে ভবঘুরেদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

আরও পড়ুন: স্তব্ধ অর্থনীতি, কিছু কল কারখানা দ্রুত খুলতে সওয়াল শিল্পমন্ত্রকের

আরও পড়ুন: বরাহনগরে ‘কোর’ এলাকায় ফোন নম্বর-সহ লিফলেট

সমাজজীবনের স্মারক বলতে পাশে থাকার এই সব চেষ্টা। কারও পুঁজি স্রেফ দহনদানের সাহসটুকু। করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসে নিভৃতবাসে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন শ্রীরামপুরের ওয়ালশ হাসপাতালের অস্থায়ী কর্মী ছয় তরুণ। সব নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে ফের ঝুঁকির কাজে ফিরতে ছটফট করছেন তাঁরা। ভগীরথ, মেহতাব, সুপ্রিয়দের একটাই কথা, “এত বড় ঝঞ্ঝাটে কাউকে তো ডাক্তারবাবুদের পাশে থাকতে হবে।”

নদিয়ার দেবগ্রামের পোস্টমাস্টারবাবু সঞ্জিত হালদারও সঙ্কটে ময়দান ছাড়েননি। গড়িয়ার নবগ্রামের বাড়ি থেকে সাইকেলে কাজে গিয়েছেন। কৃষ্ণনগরের পালপাড়া মোড়ে পুলিশকর্মীরা তাঁকে সাইকেলসুদ্ধ আনাজের গাড়িতে তুলে দেন। সঞ্জিতবাবুর লাজুক হাসি, “এখন গরিব গ্রাহকেরা আসছেন ভাতার টাকা নিতে। আমায় যেতেই হত।”

হা-ক্লান্ত সন্ধ্যায় দু’বছরের দস্যি মেয়ে কোলে ঝাঁপাতে এলে বুক কাঁপে বাঁকুড়ার বড়জোড়ার সরালির আশাকর্মী সহেলি সুলতানার। অতটুকু বাচ্চা কি বোঝে, পাড়ায় পাড়ায় ভিন্ রাজ্য ফেরত শ্রমিকদের দেখভাল সেরে মা ফিরেছে? বাঁকুড়ারই ইঁদপুরের আশাকর্মী বন্দনা চক্রবর্তীর বাড়িতেও

ষাটোর্ধ্ব স্বামী। এলাকায় ভিন্‌ রাজ্য ফেরত ৪০ জন। তাঁদের মধ্যে দু’জন যক্ষ্মার রোগী। গ্লাভস, স্যানিটাইজ়ারের সুরক্ষা ছাড়াই তাঁকে লড়তে হচ্ছে।

ডাক্তারবাবুর ছকে-বাঁধা ভূমিকাটাও পাল্টে দিয়েছে করোনা। সালকিয়ার কোভিড আক্রান্ত প্রৌঢ়াকে বিশেষ প্রয়োজনে আইডি থেকে সল্টলেকের বেসরকারি হাসপাতালে সরাতে হয়েছিল। কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রে তখন বেহুঁশ তিনি। ভেন্টিলেটর সামলাতে ভরসা পাচ্ছিলেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা। সংক্রামক রোগের চিকিৎসক যোগীরাজবাবু নিজেই পিপিই বা বর্মবস্ত্রে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠে পড়লেন।

পুরুলিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) তথা ডাক্তার আকাঙ্ক্ষা ভাস্কর কার্যত দশ হাতে ‘ওয়ার রুম’ সামলাচ্ছেন। এলাকায় এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মী থেকে গৃহবন্দিদের খুঁটিনাটি তাঁর নখদর্পণে। আবার স্বনির্ভর দলের মহিলাদের দিয়ে মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার তৈরির কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন। ও দিকে লকডাউনে শহরে আটক আট বছরের রোগিণী অ্যাঞ্জেলা বাস্কেকে রামপুরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামে
পৌঁছতে নিজেই গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসেছেন পিজি-র ডাক্তার বাবলু সর্দার। সময় মতো ফের ডিউটিতেও হাজির।

করোনা প্রতিরোধই নতুন করে চেনাচ্ছে এমন কত জনকে। আতঙ্কে মজুতদারির প্রবণতাই শেষ কথা নয়। কানাকড়ি সম্বল করে অন্নদানে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগিদও বিস্তর। রাজ্যের ওয়াকফ সম্পত্তির কর্ণধার কিরণকুমার গুপ্ত রোজ ভবানীপুরে ১০০ জনকে খাওয়াচ্ছেন। নিয়ম করে সাবান, স্যানিটাইজ়ারে তাঁদের পরিচ্ছন্নতার বিধি বাতলে দেওয়ার ভারও কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

ভাইরাসের ভয়কে বলে বলে হারিয়ে দিচ্ছে মানুষ-রতন।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE