Advertisement
E-Paper

‘ওস্তাদ’ মারলে বাঁচাবে কে! এটাই মর্মকথা

হুগলি নদীপাড়ের ডায়মন্ড হারবারে তৃণমূল প্রার্থী অভিষেকই ভোটের প্রচারের শুরুতে মাসখানেক আগে দু’তিনটে সভায় বলে গিয়েছিলেন, ‘‘১২ মে-র পরে এলাকায় আসব। ওস্তাদের মার শেষ রাতে, এটা মনে রাখবেন।’’ এসেছেনও ঠিক ওই তারিখ মেনেই।

দেবারতি সিংহ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৯ ০২:৪৯

আগাম জানিয়েই গিয়েছেন তিনি। তাই নিজের কেন্দ্রে প্রচারে এসেছেন ভোটের দিন সাতেক আগে। এখনও পর্যন্ত মাত্র এক দফার সাংসদ। পোড়খাওয়া রাজনীতিক বললে অত্যুক্তি হয়! আবার ক্ষমতায়, প্রতাপে নিজের দলেরই মহাতারকা বললেও কম বলা হয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

হুগলি নদীপাড়ের ডায়মন্ড হারবারে তৃণমূল প্রার্থী অভিষেকই ভোটের প্রচারের শুরুতে মাসখানেক আগে দু’তিনটে সভায় বলে গিয়েছিলেন, ‘‘১২ মে-র পরে এলাকায় আসব। ওস্তাদের মার শেষ রাতে, এটা মনে রাখবেন।’’ এসেছেনও ঠিক ওই তারিখ মেনেই।

‘ওস্তাদের মার’ কথাটা এখানে ব্যঞ্জনাময়, কারণ বছরখানেক আগের ডায়মন্ড হারবারে গ্রামের পর গ্রামে বুথ পর্যন্ত পৌঁছতে না পারার ক্ষোভ এখনও জ্বলজ্বলে! পঞ্চায়েত ভোটে ডায়মন্ড হারবারের ৯০% আসনই ঘাসফুল দখল করেছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ভোট দিতে না পারার ক্ষোভের আঁচে নতুন ভোটার থেকে মাঝবয়সি পড়ালেখা না জানা বধূ, জরির কাজ করে সংসার চালানো প্রৌঢ় রাখঢাক না রেখে সপাটে বলছেন, ‘‘ভোটটাই তো দিতে পারলাম না! তৃণমূল তো ভোটই দিতে দিল না!’’

ভোট দিতে না পারা অসচ্ছল মুখগুলো গনগনে রোদের মধ্যেও খোলা মাথায় বালতি, বোতল নাইলনের ব্যাগে ভরে জল আনতে যাচ্ছে বেশ অনেকটা দূরে টিউবওয়েলে। পলিথিনের আস্তরণ দেওয়া আস্তানার কোথাও স্বাচ্ছন্দ্য উঁকি দেয় না। গ্রাম পথে বেড়া-টালির ঘরের নড়বড়ে দেওয়ালে ঘাসফুলের ভোটপ্রার্থী অভিষেকের পোস্টার সাঁটা। কিছুটা দূর অন্তর বাতিস্তম্ভে, দেওয়ালে শুধুই ঘাসফুলের পতাকা গোঁজা। ধানিজমি, গাছ, আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে অনেক
খুঁজে চোখে পড়ে ছিঁটোফোঁটা
বিরোধী-অস্তিত্ব।

স্লগ ওভারের শেষ ক’দিনের ঝোড়ো প্রচারে যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক হুডখোলা জিপে হাত নাড়ছেন। তাঁর বিশ্বাস, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নে মানুষ আমাদের পাশেই রয়েছেন। সাম্প্রদায়িক দলকে মানুষ বিশ্বাস করে না। আর কংগ্রেস, সিপিএম তো সাইনবোর্ড। আমাদের কেউ ছুঁতে পারবে না।’’

এই কেন্দ্রের সাত-সাতটা বিধানসভায় জোড়াফুল ফুটে রয়েছে। কিন্তু জনান্তিকে দলের মধ্যে গুঞ্জন, এই বিধায়কদের অনেকের সঙ্গেই যুব সভাপতির খুব একটা ‘ঘনিষ্ঠতা’ নেই। পুরনোদের বদলে এলাকায় যুব তৃণমূলের ‘দাপট’ই বেশি। যদিও বজবজের বর্ষীয়ান বিধায়ক অশোক দেব সেই গুঞ্জন নস্যাৎ করে বোঝালেন, ‘‘অন্য বিধায়কদের ব্যাপারে বলতে পারব না। তবে বজবজে সভা, মিছিলের ব্যাপারে আমার সঙ্গে কথা বলেছে অভিষেক।’’ কিন্তু শুরু থেকে তৃণমূলে থাকা ফলতার প্রবীণ বিধায়ক তমোনাশ ঘোষের অকপট বক্তব্য, ‘‘দু’একটা সভা আমরা নিজেদের মতো করেছি। অভিষেক নিজে যা ভাল বুঝছে, তাই করছে।’’

দলের পুরনোদের সঙ্গে অভিষেকের এই আপাত ‘শীতলতা’ তা হলে কি একটু হলেও তলে তলে চোরাস্রোত ডেকে আনতে পারে? ডায়মন্ড হারবার স্টেশন লাগোয়া স্টেশনারি দোকানে এক তৃণমূল কর্মীকে সতীর্থ বলছেন, ‘‘চিন্তা করছিস কেন? এ বার লাখ ছাড়িয়ে যাবে দাদার মার্জিন। নিশ্চিন্তে জিতব আমরা।’’ বিড়লাপুরের চা-দোকানি হাত পাখা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘‘এখানে পঞ্চায়েত থেকে পুরসভা, বিধানসভা, লোকসভা— তৃণমূলই সব। অন্য কোনও দল এখন আর নেই এখানে।’’

তবে ‘বদলের’ গোপন ইচ্ছেও যে গঙ্গাপাড়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে না, তা নয়। রোদ-জ্বলা বিকেলে ফলতার কামারপোল গ্রামে আদুর গায়ে জরি-শ্রমিক যেমন স্পষ্টই বললেন, ‘‘পরিবর্তন চাই আমরা। এখন যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা তো কাঁঠালের কোয়াগুলো নিজেরা খাচ্ছে। আমাদের তো শুধু ছালটা খেতে দিয়েছে। কাজ দেওয়ার অনেক বড় বড় কথা শুনেছি। কিন্তু কাজ পেলাম কোথায়? ’’

কর্মসংস্থান না হওয়ার ক্ষোভ প্রশমিত করতে পদ্ম-হাওয়ায় বিজেপির প্রার্থী নীলাঞ্জন রায় বারবার গ্রাম-মফস্সলে ঘুরে ঘুরে বোঝাচ্ছেন, ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’। তবে গঙ্গাপাড়ে পদ্ম হাওয়ার মধ্যেও ৩৭% সংখ্যালঘু ভোট অনেকটাই চিন্তায় রেখেছে গেরুয়া শিবিরকে। গত বার বিজেপি ছিল তৃতীয় স্থানে। তৃণমূলের সঙ্গে ভোটের ব্যবধানও ছিল প্রায় তিন লাখ। তা সত্ত্বেও নীলাঞ্জন বোঝাতে চাইছেন, ‘‘সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অসমেও এখন বিজেপি সরকার। এখানেও আমরা সংখ্যালঘু ভোট পাব না কেন? গত বার আমরা এখানে ১৬% ভোট পেয়েছিলাম। মিলিয়ে নেবেন, এ বারও চমকে দেওয়ার মতো ভোট পাব।’’

গত বার সিপিএমকে ৭১ হাজার ২৯৮ ভোটে হারিয়েছিলেন অভিষেক। লোকসভার নিরিখে এই ভোট-মার্জিন খুব একটা আহামরি নয়। তার উপর লাল পতাকার ক্ষয়ের বাজারেও সকাল থেকে দুপুর লু-হল্কায় সিপিএমের প্রার্থী ফুয়াদ হালিম যে ভাবে চক্কর কাটছেন, তাতে সিপিএমের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি এবং প্রচারের উদ্যম নজর এড়ায় না। সংখ্যালঘু ভোট কিছুটা হলেও জোড়াফুল থেকে ছিন্ন হবে বলেই আশা লাল পতাকা শিবিরেরও। আর অনেকেরই ধারণা, মূল লড়াই এ বারও হবে তৃণমূলের সঙ্গে সিপিএমেরই।

রাজ্যের প্রয়াত প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমের চিকিৎসক পুত্র ফুয়াদ দিনে-রাতে পায়ে হেঁটে, গাড়ি চেপে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, মেঠো পথ থেকে পিচরাস্তায় পৌঁছে যাচ্ছেন। বজবজের বিড়লাপুর, পুজালি, খড়িবেড়িয়া চক্কর কাটতে কাটতে তাঁর একটাই আশা, ‘‘মানুষ এ বার ভোট দিতে পারলে ডায়মন্ড হারবারে বদল ঠেকানো মুশকিল।’’ তাঁর সঙ্গে এলাকা চষে বেড়ানো সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর আশা, ‘‘এখানে মেরুকরণের হাওয়া এ বার অনেকটাই জোরালো। সেই হাওয়ায় আমরা অনেকটাই সংখ্যালঘু ভোট পাব মনে হচ্ছে।’’

বরাবরই ডায়মন্ড হারবারের সংখ্যালঘু ভোটের কিছুটা ভাগ ‘হাত’ টেনে নেয়। এখন দুর্বল হলেও ভোট কাটাকাটিতে এ বারও তার অন্যথা হবে না বলে নিশ্চিত কংগ্রেস প্রার্থী সৌম্য আইচ রায়। জেলার সাধারণ সম্পাদক সৌম্য রোড শো করে এলাকার পর এলাকা ঘুরে মানুষকে বোঝাচ্ছেন, ‘‘ভয় না
পেয়ে ভোটটা দেবেন। আপনারা পঞ্চায়েতে ভোট দিতে পারেননি। তার বদলা নিন এ বার।’’

ডায়মন্ড হারবারে তৃণমূলের পক্ষে এবং বিপক্ষে প্রচারের একটি বড় বিষয় হল, ‘পিসি-ভাইপো’। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ-রা যেমন বারবার ‘বুয়া-ভাতিজা’ বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেককে এক বন্ধনীতে এনে আক্রমণের নিশানা করেছেন, অপর দিকে তেমনই তৃণমূলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সভাপতি শুভাশিস চক্রবর্তীও বোঝালেন, ‘‘মোদীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রধান মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয় মুখ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। শাহর বিরুদ্ধে মানহানির নোটিস দিয়েছিলেন অভিষেক। সেই ক্ষোভেই ওঁকে টার্গেট করা হচ্ছে।’’

যদিও ডায়মন্ড হারবারে ঘাসফুলের উর্বর জমিতে বদলের ফসল ফলানো যে ‘সহজ’ নয়, তা টের পাচ্ছেন তিন বিরোধীই। জোড়াফুলের শক্তি, সংগঠনের সঙ্গে যুঝতে মাস দেড়েক ধরে বিরোধীরা মাটি আঁকড়ে রয়েছেন। আর ‘শেষ রাতের ওস্তাদ’ অন্য সব ‘দায়িত্ব’ সেরে এলাকায় এসেছেন একেবারে শেষ প্রহরে। এটাই হয়তো অভিষেকের ‘প্রভাবে’র প্রকাশ।

তবে পঞ্চায়েত ভোটের স্মৃতি মোছেনি বলেই ডায়মন্ড হারবারের গ্রামের পর গ্রাম এ বার ভোট দিতে উন্মুখ। তাঁরা এ বার লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে চান।

তাঁদের এই চাওয়াই আসল ‘ওস্তাদের মার’।

লোকসভা নির্বাচন ২০১৯ Abhishek Banerje TMC Diamond Harbour Panchayat Election Lok Sabha Election 2019 BJP Nilanjan Roy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy