Advertisement
E-Paper

ঢুকতেই পারেননি বিজেপি প্রার্থী, কিন্তু ময়দান কি ফাঁকা? সংশয়ে তৃণমূলও

খাঁ খাঁ দুপুরে ছুটতে ছুটতে তেতেপুড়ে অস্থির মন্ত্রী। গ্রামে ঢোকার পরে গাড়ি থেকে নেমে আগে মিনারেলড্‌ ওয়াটারের বোতল ঢক ঢক করে গলায় উপুড় করে দিলেন। তার পরে অল্প একটু হেঁটে তেমাথায় পৌঁছতেই শুরু হল পুষ্পবৃষ্টি।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৯ ২১:৫১
বিষ্ণুপুরে মূল লড়াই শ্যামল আর সৌমিত্রর মধ্যেই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বিষ্ণুপুরে মূল লড়াই শ্যামল আর সৌমিত্রর মধ্যেই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

হঠাৎ মনে হল ‘হযবরল’-র দেশ বুঝি। হুবহু মিলে যাচ্ছে লাইনগুলো। সেই ‘বেজায় গরম’, সেই ‘গাছতলায় অপেক্ষা’। মোরাম রাস্তার কোনায় বসে একটা ‘বেড়াল’ও বেশ ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রয়েছে। আর যাঁর জন্য এই অপেক্ষা, তাঁর নাগাল কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানে রয়েছেন বলে খবর আসছে, সেখানে পৌঁছে দেখা যাচ্ছে তিনি এইমাত্র বেরিয়ে গিয়েছেন। ঠিক যেন সেই ‘গেছো দাদা’।

যে গ্রাম থেকে শ্যামল সাঁতরার রোড শো শুরু হওয়ার কথা, সেখানে পৌঁছে জানা গেল, তিনি বেরিয়ে গিয়েছেন। ফোন ধরে তাঁর এক সহকর্মী বললেন, ‘‘আমরা মুড়াকাটায় ঢুকছি, এখানে চলে আসুন।’’ ঊর্ধশ্বাসে সে দিকে ছুটে গিয়ে জানা গেল, মুড়াকাটা ছেড়েও এই মাত্র বেরিয়ে গেলেন। এখন পাশের গ্রামটায় রয়েছেন। এর পরে যাবেন জামতোড়া। অতএব সেই ‘হযবরল’-র ঢঙে ‘আঁক কষে’ই সিদ্ধান্ত নিতে হল যে, আপাতত জামতোড়া যাওয়ার রাস্তার ধারে এই গাছতলাতেই অপেক্ষা করা যাক। কারণ এই রাস্তা দিয়েই তাঁকে যেতে হবে।

সেই অঙ্কই কাজে লাগল শেষমেশ। মাঝরাস্তায় কনভয় থামিয়ে পরিচয় দিতেই রাজ্যের মন্ত্রী তথা কোতুলপুরের বিধায়ক শ্যামল সাঁতরা তুলে নিলেন তাঁর হুডখোলা গাড়িতে। কনভয় হু হু করে ছুটল জামতোড়ার দিকে।

এ ভাবেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার করেছেন শ্যামল সাঁতরা।—নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: দলিত ক্ষোভের হাওয়া পালে টেনে গ্বালিয়র কেল্লা পুনরুদ্ধারে জ্যোতিরাদিত্য​

বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থীর এতটা দৌড়নোর প্রয়োজন কি আদৌ রয়েছে? এ বারের ভোটে বিষ্ণুপুরে যারা তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ, সেই বিজেপির প্রার্থী সৌমিত্র খাঁ তো আদালতের নির্দেশে বাঁকুড়া জেলায় ঢুকতেই পারছেন না। সুতরাং প্রচারে হাজিরও হতে পারছেন না সশরীরে। তা হলে এমন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেড়ানোর কোনও প্রয়োজন কি আদৌ ছিল শ্যামল সাঁতরার? তৃণমূল সম্ভবত উল্টোটাই ভাবছে। এলাকার বিদায়ী সাংসদ তৃণমূল ছেড়ে দিয়ে বিজেপির প্রার্থী হয়ে গিয়েছেন। সংগঠনের লোকজন তাঁর হাত ধরে বেরিয়ে যায়নি, সে কথা ঠিকই। কিন্তু বিদায়ী সাংসদ তৃণমূল ছেড়ে নিজের কেন্দ্রেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ছেন— এমন পরিস্থিতি তো রাজ্যের আর কোনও আসনে নেই। সুতরাং একটু বাড়তি সতর্কতা নেওয়া জরুরি বলেই তৃণমূল মনে করছে। যদিও মুখে সে কথা এক বারও বলছেন না বাঁকুড়ার তৃণমূল নেতৃত্ব।

খাঁ খাঁ দুপুরে ছুটতে ছুটতে তেতেপুড়ে অস্থির মন্ত্রী। গ্রামে ঢোকার পরে গাড়ি থেকে নেমে আগে মিনারেলড্‌ ওয়াটারের বোতল ঢক ঢক করে গলায় উপুড় করে দিলেন। তার পরে অল্প একটু হেঁটে তেমাথায় পৌঁছতেই শুরু হল পুষ্পবৃষ্টি। চেয়ার টেবিল পেতে ফুলের মালা সাজিয়ে প্রার্থীর অপেক্ষায় গ্রামের গণ্যমান্যরা। বেরিয়ে এলেন পাড়ার প্রায় সব লোকই। প্রবীণ নাগরিকের পা ছুঁয়ে চেয়ারে বসলেন শ্যামল। বসলেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি অরূপ খাঁ-ও। জামতোড়া যে বিধানসভা কেন্দ্রে, সেই ওন্দা অরূপের নিজের আসন। তাই তিনিও ছুটছেন শ্যামলের সঙ্গে। বন্দে মাতরম আর জয় হিন্দ স্লোগান তুলে প্রথমে মালা পরানো হল শ্যামলকে। কিন্তু রোদ থেকে বাঁচার জন্য অরূপের মাথায় তালপাতার টোকা। মালা ঢুকছে না। তাই মালা ছিঁড়ে গলায় পরিয়ে ফের বেঁধে দেওয়া হল। কোল্ড ড্রিংক, দই, মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন হল। ঢাকের বোলে মিছিল করে ঠাকুরদালানে গিয়ে মাথা ঠুকলেন প্রার্থী। ফের মিছিল করেই ধরলেন গ্রামে ঢোকার মুখে অপেক্ষমান কনভয়ে পৌঁছনোর পথ।

সৌমিত্র খাঁ বিজেপির প্রার্থী হওয়ার জেরেই এত জোরকদমে প্রচারে নামতে হল? শ্যামল সাঁতরা বললেন, ‘‘আমি তো কোনও প্রতিপক্ষই দেখতে পাচ্ছি না।’’ তার পরে যোগ করলেন, ‘‘যাঁরা ভোটে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা সকলেই প্রতিপক্ষ। কাউকেই হালকা ভাবে নিচ্ছি না।’’ শ্যামল বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, সৌমিত্র খাঁ-কে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন না তিনি, বাকি সব প্রতিদ্বন্দ্বী যেমন, সৌমিত্রও তাঁর কাছে তেমনই।

‘‘পাত্তা না দেওয়ার ফলটা ২৩ মে টের পাবেন।’’ বললেন বিজেপির পশ্চিমাঞ্চল সাংগঠনিক জোনের পর্যবেক্ষক নির্মল কর্মকার। সৌমিত্র খাঁ-ই বিষ্ণুপুরে তৃণমূলের টেনশনের সবচেয়ে বড় কারণ— দাবি নির্মলের। ‘‘কোতুলপুরের বিধায়ক ছিলেন, পরে বিষ্ণুপুরের সাংসদ। সৌমিত্রকে গোটা এলাকার মানুষ চেনেন। সেটাই তৃণমূলের সবচেয়ে বড় ভয়,’’—বলছেন নির্মল।

কিন্তু সবাই চিনলেই বা কি যায় আসে? ফৌজদারি মামলার জেরে আদালতের নির্দেশে বাঁকুড়া জেলার ত্রিসীমানায় তো আপাতত ঘেঁষতে পারছেন না সৌমিত্র। বিষ্ণুপুর সংসদীয় ক্ষেত্রের মধ্যে যে ৭টি বিধানসভা কেন্দ্র, তার মধ্যে একমাত্র খণ্ডঘোষ বাঁকুড়া জেলার বাইরে। পূর্ব বর্ধমানের সেই খণ্ডঘোষেই শুধু সশরীরে প্রচার সারতে পেরেছেন সৌমিত্র। বাকিটায় প্রায় ফাঁকা ময়দানে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন শ্যামল সাঁতরা।

আরও পড়ুন: বসিরহাটের মানুষ দাঙ্গা করেননি, দুর্বৃত্ত ঢুকিয়ে করানো হয়েছে: মমতা​

এই ‘ফাঁকা ময়দান’ কথায় ঘোর আপত্তি দু’পক্ষেরই। জেলা তৃণমূল সভাপতি অরূপ খাঁ বলছেন, ‘‘ফাঁকা ময়দান বলে কিছুই হয় না। নির্বাচনকে আমরা নির্বাচন হিসেবেই দেখি।’’ আর বিজেপির পর্যবেক্ষক নির্মল কর্মকার বলছেন, ‘‘কে বলল আমরা ফাঁকা ময়দান ছেড়ে দিয়েছি! সৌমিত্র খাঁয়ের স্ত্রী সুজাতা খাঁকে সামনে রেখে আমরা সর্বত্র পৌঁছে গিয়েছি। আর যে খণ্ডঘোষে আমরা দুর্বল ছিলাম, সেখানে সৌমিত্র নিজে অনেকটা সময় দিতে পেরেছেন। ফলে ওখানেও আমরা এগিয়ে থাকব।’’

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিষ্ণুপুর লোকসভা এলাকায় ৩টি বিধানসভা কেন্দ্রের দখল নিয়ে নিয়েছিল বাম-কংগ্রেস জোট। বিষ্ণুপুর বিধানসভায় জিতেছিলেন কংগ্রেসের তুষারকান্তি ভট্টাচার্য। বড়জোড়া আর সোনামুখীতে জিতেছিল বামফ্রন্ট। পরে তুষারকান্তি তৃণমূলে চলে যান ঠিকই। কিন্তু ৭টির মধ্যে ৩টি বিধানসভায় জিতে বাম-কংগ্রেস বুঝিয়ে দিয়েছিল, বিরোধীরা এক হলে এলাকায় টক্কর দেওয়া সম্ভব তৃণমূলকে।

বাম এবং কংগ্রেসের অবস্থাটা অবশ্য আর আগের মতো নেই বিষ্ণুপুরে। সিপিএমের তরফে ময়দানে রয়েছেন সুনীল খাঁ। দুর্গাপুরের প্রাক্তন সাংসদ তিনি। কিন্তু প্রচারের বহর দেখলে মনেই হয় না যে, লড়াই দেওয়ার কোনও ইচ্ছা রয়েছে। আর কংগ্রেস প্রার্থী নারায়ণ চন্দ্র খাঁকে মেনে নিতে রাজি নন স্থানীয় কংগ্রেস কর্মীদেরই অনেকে। সংগঠন বলতে আর কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই। যেটুকু রয়েছে, সেখানেও ক্ষোভ-বিক্ষোভের আঁচ নারায়ণকে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে।

বিজেপি-র সৌমিত্র খাঁ এলাকায় ঢুকতে না পারায় তাঁর হয়ে প্রচারে স্ত্রী সুজাতা খাঁ।—নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: প্রাইভেট জেট পাঠিয়ে টিউমার আক্রান্ত শিশুকে দিল্লি উড়িয়ে আনলেন প্রিয়ঙ্কা​

সিপিএম-কংগ্রেস আগের চেয়ে দুর্বল হয়েছে ঠিকই। কিন্তু কংগ্রেসকে বা বামেদের যাঁরা ভোট দিয়েছিলেন ২০১৬-য়, তাঁরা সব তৃণমূলে সামিল হয়েছেন, এমনটা মোটেই নয়। এলাকার তৃণমূল নেতারাও সে কথা জানেন। লড়াই যখন শ্যামল আর সৌমিত্রর মধ্যে, তখন ওই ভোটাররা কোন দিকে ঝুঁকতে পারেন, তা-ও তৃণমূল নেতারা আঁচ করতে পারছেন। অতএব প্রচারে কোনও রকম খামতি তাঁরা থাকতে দেননি।

বিজেপি নেতাদের হিসেব অবশ্য একেবারেই অন্য রকম। ২০১৬-র ফলাফলকে গুরুত্বই দিচ্ছে না বিজেপি। ৭টি বিধানসভাতেই এগিয়ে থাকবেন সৌমিত্র, দাবি গেরুয়া শিবিরের জেলা নেতৃত্বের। প্রার্থী শ্যামল সাঁতরার নিজের এলাকা কোতুলপুর, জেলা তৃণমূল সভাপতি অরূপ খাঁয়ের নিজের এলাকা ওন্দা এবং সোনামুখী থেকে সৌমিত্র সব থেকে এগিয়ে থাকবেন বলে গেরুয়া শিবিরের দাবি। বিষ্ণুপুর, ইন্দাস, বড়জোড়া, এবং খণ্ডঘোষেও সামান্য ব্যবধানে বিজেপি-ই এগিয়ে থাকবে বলে তাঁরা মনে করছেন। এত বড় স্বপ্ন কিসের ভিত্তিতে দেখছেন? বিজেপির জোনাল ইনচার্জ বললেন, ‘‘স্বপ্ন নয়, এটাই বাস্তব। মিলিয়ে নেবেন। সৌমিত্র খাঁয়ের স্ত্রীকে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ঘুরতে হয়েছে মানুষের দরজায়। এর প্রভাবটা কী হয়, তৃণমূল বুঝতে পারবে।’’

Lok Sabha Election 2019 Mamata Banerjee Trinamool TMC BJP Bishnupur CPM Congress
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy