Advertisement
E-Paper

‘দিদি’ বাছার সংগ্রামে ঘাম ঝরছে দেদার

গত লোকসভা নির্বাচনে হুগলি লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেই ফুল ফুটিয়েছে তৃণমূল।

কৌশিক ঘোষ 

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৯ ০৩:৪৩

কাঠফাটা বৈশাখের রোদ্দুরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের কাছে সিঙ্গুরে ঢোকার মুখে জমায়েত। এই রাস্তা ধরেই হুগলির বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায় মিছিল করে সিঙ্গুর থানা ঘেরাও করার কর্মসূচি নিয়েছেন। ঘটনাস্থলে সবাই যে বিজেপি কর্মী বা সমর্থক আছেন তা নয়, এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারাও জমায়েত হয়েছেন শুধু নেত্রীকে দেখার জন্য। বিজেপির থানা ঘেরাও কর্মসূচিতে তাঁদের অনেকে অংশগ্রহণ না-করলেও থানা পর্যন্ত তাঁর ওই অভিযানের সঙ্গী থাকলেন। সিঙ্গুর ছাড়াও হুগলি, চন্দননগর, বলাগড়, জিরাট, কামালপুর, মুক্তারপুর-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার কর্মী-সমর্থক সামিল ছিলেন বিজেপির রোড-শোয়ে। দলের সাংগঠনিক নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাসিন্দা তথা বিজেপির কর্মীদের এই উন্মাদনা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।

হুগলি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে কৃষিপ্রধান জায়গা ছাড়াও রয়েছে গঙ্গার দু’ধারের শিল্পাঞ্চল। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে ঘাসফুলের রঙ। জমায়েত বা জনসভা নয়, এলাকার অনেক মানুষের মুখেই ঘুরে ফিরে শোনা গিয়েছে বিদায়ী সাংসদ রত্না দে নাগের নাম। রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী তপন দাশগুপ্তের কথায়, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন আমাদের দেশের দিদি। রত্নাদি হলেন পাড়ার দিদি। মানুষের পাশেই সব সময়ই তিনি দাঁড়ান।’’ স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই তপনবাবুর এই কথাকে সিলমোহর দিয়েছেন। সপ্তগ্রামের বাসিন্দা নরেন দত্ত বলেন, ‘‘রত্নাদি কোনও দলের নয়, আমাদের সবার। রত্নাদির কোনও জনসভার প্রয়োজন হয় না। আর তা ছাড়া এই জমিতে তো বারবারই ঘাসফুল ফুটেছে।’’

গত লোকসভা নির্বাচনে হুগলি লোকসভা কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেই ফুল ফুটিয়েছে তৃণমূল। আর তার জেরে সিপিএম প্রার্থীকে ১,৮৯,০৮৪ ভোটে হারিয়েছিলেন বিদায়ী সাংসদ তথা এ বারের তৃণমূল প্রার্থী রত্না দে নাগ। গত বারে বিজেপি এই জেলায় তৃতীয় শক্তি ছিল তো বটেই। এমনকি পেয়েছিল মোট ভোটের মাত্র ১৬.৪০ শতাংশ। সিপিএম এবং কংগ্রেস পেয়েছিল যথাক্রমে ৩১.৫২ শতাংশ এবং ৩.১৩ শতাংশ। তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৫.৫৬ শতাংশ। তৃণমূল প্রার্থীর থেকে বিজেপি প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ছিল ৩,৯৩,০৪১।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এক নজরে হুগলি

• মোট ভোটার: ১৭ লক্ষ ৬২ হাজার ৯২৭।
• ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে জয়ী তৃণমূলের রত্না দে নাগ। জয়ের ব্যবধান ১ লক্ষ ৮৯ হাজার ১৪।
• ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে এগিয়ে তৃণমূল। মোট ৭টি বিধানসভার মধ্যে ৬টিতে তৃণমূল, ও ১টিতে সিপিএম জয়ী।

একইভাবে বিধানসভা নির্বাচনেও হুগলি লোকসভার অন্তর্গত পান্ডুয়া বাদে বাকি ৬টি কেন্দ্রেই নির্বাচিত হয়েছেন তৃণমূলের প্রতিনিধি। পান্ডুয়ায় জিতেছিলেন সিপিএম প্রার্থী। তৃণমূল জয়ের ধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছে পঞ্চায়েত নির্বাচনেও। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট ৩,১৯২টির মধ্যে তৃণমূল একাই পেয়েছিল ২,৭৭১টি আসন। পঞ্চায়েত সমিতির ৬০৭টি আসনের মধ্যে ৫৯৩ এবং জেলা পরিষদে ৫০টি আসনের মধ্যে ৫০টিই পেয়েছিল তৃণমূল।

তৃণমূলের জয়ের ধারাকে কী ভাবে প্রতিরোধ করবে বিজেপি? প্রশ্ন থেকে যায়, এতগুলি নির্বাচনেও বিজেপি কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি কেন? জেলার বিজেপি নেত্রী বেবি তেওয়ারি বলেন, ‘‘সাংগঠনিক দুর্বলতা তো ছিলই। কিন্তু বর্তমানে বিজেপির পালে সারা দেশ জুড়ে যা হাওয়া, তাতে সাফল্য পাওয়া অসম্ভব কিছু না। লকেটদি যে ভাবে ভোট প্রচার করছেন এবং তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে সরব, তা আগে কেউ করেননি।’’ যদিও এই বিষয়টিকে আমল দিতে চাননি স্থানীয় তৃণমূলের কোনও নেতাই। তাঁদের মতে, প্রচারে পিছিয়ে নেই রত্নাদেবীও। তাঁর ঝুলিতেই এলাকার সাফল্যের চাবিকাঠি রয়েছে বলে তাঁদের ধারণা।

রোদ একটু পশ্চিম দিকে হেলতেই চন্দননগরের খলসানিতে লাল ভিনটেজ গাড়িতে চড়ে প্রচারের অভিযানে বেরোলেন তৃণমূল প্রার্থী। সামনে সাদা আর সবুজ বেলুনে সেজেছে অসংখ্য টোটো। রয়েছে তৃণমূলের প্রতীকের কাটআউটও। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূল উন্নয়ন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষ্য রেখেই ভোট করতে চায়।’’ জনসভা নয়, হেঁটে বা গাড়িতে চড়ে মানুযের কাছে পৌঁছে তিনি অভাব-অভিযোগ শুনতে চান। এ দিন গাড়ি থেকে নেমেই কয়েক জনের অভাব অভিযোগ শুনলেন সাংসদ। এলাকার উন্নয়ন যেমন হয়েছে, একই ভাবে জড়ো হয়েছে অভিযোগও।

এ বারে আলুচাষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চাষিরা। পেঁয়াজ রাখার কোনও হিমঘর নেই। পেঁয়াজের দাম দিতে না পারায় গত মাসে এলাকায় দু’জন কৃষক ‘আত্মহত্যা’ করেছেন বলেও অভিযোগও করেছেন বিরোধীরা। বলাগড়ের পুরাতন বগা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাওয়া পেঁয়াজ খেত থেকে তোলাই যায়নি। হেমন্ত দাস নামে এক কৃষক বলেন, ‘‘এখন এমন অবস্থা যে গোটা গ্রাম পচা পেঁয়াজের গন্ধে ম ম করছে। গাড়ি করে পেঁয়াজ তুলে গ্রামের বাইরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।’’ তিনি জানান, সম্প্রতি খবর পেয়েই রাজ্য প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এলাকা পরিদর্শন করেছেন।’’

কৃযিপণ্যের এই বিষয়টিকেই নির্বাচনী হাতিয়ার করেছেন বিজেপি ছাড়াও বাকি দুই বিরোধী দল— সিপিএম এবং কংগ্রেস। সিপিএম প্রার্থী প্রদীপ সাহা বলেন, ‘‘জেলায় আলু এবং পেঁয়াজের বিপর্যয়। কৃযক দাম না-পেয়ে মারা যাচ্ছে। সরকারের কোনও হুঁশ নেই। জেলার বড় শিল্পও ভেঙে পড়েছে।’’ কংগ্রেস প্রার্থী প্রতুলচন্দ্র সাহা বলেন, ‘‘বিজেপি এবং তৃণমূল যে উন্নয়নের বড়াই করে, তা কোথায়? জেলার শিল্প এবং কৃষি— দুই-ই নষ্ট।’’ লকেট বলেন, ‘‘শিল্পের জমিতে যে চাষ হয় না, তা সবার জানা। তা সত্ত্বেও সরকার ভুল বুঝিয়ে মানুষকে ওই জমি ফেরত দিয়ে চাষ করতে বলেছে। ফলে কিছুই তাঁরা পাচ্ছেন না। আমাদের দলের মূল লক্ষ্য শিল্প ও কৃযির মেলবন্ধন। আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন তো আছেই।’’

বিরোধীদের তোলা এই অভিযোগের চটজলদি উত্তর দিয়েছেন সাংসদ। তাঁর কথায়, ‘‘আলুর ফলন বেশি হওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। অন্য চাষের কথাও বলা হয়েছে। সিঙ্গুরের সমস্ত জমি কৃষিযোগ্য করা একটু সময়সাপেক্ষ। পেঁয়াজের দাম কমে যাওয়ায় বলাগড়ে অসুবিধায় পড়েছেন কৃযকেরা।’’ তিনি জানান, সমস্যার কথা ভেবেই বলাগড়ে রাজ্যের পেঁয়াজের হিমঘর তৈরি করা হচ্ছে। এখানেই তৈরি হবে আর্সেনিক প্রতিরোধ করার প্ল্যান্ট। রয়েছে জল, আলো ও রাস্তার অজস্র ফিরিস্তি।

ফেরার পথে রাস্তার ধারে চোখে পড়ল সমস্ত দলের নির্বাচনী জনসভার মঞ্চ। বিভিন্ন দলের প্রতীকের আলোয় ঝলমল করছে। কোথাও বেশি লোক। কোথাও কম। নিত্যদিনের খাটাখাটনির পরে, নতুন আশায় তাঁরা যেন ফের বাঁচার জন্য বুক বাঁধেন।

Lok Sabha Election 2019 Hoogly Singur লোকসভা নির্বাচন ২০১৯ BJP
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy