Advertisement
E-Paper

যুগলের রক্তে ভিজল তপনের রাস্তা

মেয়েটি ছিল শান্ত নম্র। এলাকার প্রায় সকলেই সুমনা খাতুনের সম্পর্কে এমনই বলছেন। সাত সকালে তার রক্তাক্ত দেহ দেখে গোটা পাড়াই শোকে বিহ্বল। তার উপরে রয়েছে আতঙ্ক। কারণ, পাশেই পড়েছিল পাড়ার সকলেরই পরিচিত মামুদ মণ্ডলের দেহ। অদূরে রক্তমাখা ছুরি। প্রেম, বিয়ের প্রস্তাব, তা নিয়ে মত বিরোধ, এর জেরে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি কেউ।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৫ ০১:৫৪
রক্তের দাগ তখনও টাটকা। তপনে অমিত মোহান্তের তোলা ছবি।

রক্তের দাগ তখনও টাটকা। তপনে অমিত মোহান্তের তোলা ছবি।

মেয়েটি ছিল শান্ত নম্র। এলাকার প্রায় সকলেই সুমনা খাতুনের সম্পর্কে এমনই বলছেন। সাত সকালে তার রক্তাক্ত দেহ দেখে গোটা পাড়াই শোকে বিহ্বল। তার উপরে রয়েছে আতঙ্ক। কারণ, পাশেই পড়েছিল পাড়ার সকলেরই পরিচিত মামুদ মণ্ডলের দেহ। অদূরে রক্তমাখা ছুরি। প্রেম, বিয়ের প্রস্তাব, তা নিয়ে মত বিরোধ, এর জেরে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি কেউ। ফলে ঘটনার পরে এলাকার অভিভাবক মহলে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। সকলেই চাইছেন, এই ধরনের হিংসাত্মক ঘটনার প্রভাব যাতে এলাকায় না পড়ে, সে জন্য প্রশাসনকে উদ্যোগী হতে হবে। পুলিশ জানিয়েছে, সচেতনতা শিবির করা হবে। এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও এমন সচেতনতা শিবির করা হতে পারে বলে কথাবার্তা হচ্ছে।

প্রেমের সম্পর্ক অস্বীকার করে সরে আসায় প্রতিবেশী কিশোরীকে খুন করে নিজের গলাতেও একই ছুরি চালিয়ে যুবক মামুদ হোসেনের আত্মহত্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে শহরে। নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে গলার নলি কেটে আত্মহত্যার অভিযোগ মানতে চাননি মামুদের আত্মীয়রা। তাঁর দিদি মাসুদা বিবির সন্দেহ ওই কিশোরীকে খুন করার পরে তাঁর ভাইকে ওই ছুরি দিয়ে গলার নলি কেটে হত্যা করা হয়েছে। তার সন্দেহের তির নিহত সুমনা খাতুনের পরিবারের দিকে। অবশ্য সুমনার কাকা আব্দুল সামাদ মন্ডলের ওই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, ‘‘ভাইঝিকে খুন করে অভিযুক্ত মামুদ নিজেও গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে।’’ দূর থেকে তিনি সেটা দেখেছেন বলে দাবি করেছেন।



তপনে পুলিশি টহল।—নিজস্ব চিত্র।

মৃত মামুদের জামাইবাবু নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘মৌখিক ভাবে আমরা পুলিশকে ওই সন্দেহের কথা জানিয়েছি।’’ তবে রাত পর্যন্ত তাঁদের পক্ষ থেকে থানায় কোনও লিখিত অভিযোগ করা হয়নি। জেলা পুলিশ সুপার শীশরাম ঝাঝারিয়া বলেন, মামুদের পরিবারের তরফে এখনও কোনও অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। সব দিক খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে ওই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

তবে অভিযুক্ত মামুদের ওই পদক্ষেপের পিছনে অবহেলা ও চরম হতাশা কাজ করেছে বলে মনস্তাত্ত্ববিদদের ধারণা। আপাতশান্ত স্বভাবের মামুদের মরিয়া হয়ে এত বড় একটা পদক্ষেপ নেওয়ার পিছনে ওই হতাশা ও অবহেলা ছিল বলেই পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত থেকেও বিষয়টি উঠে এসেছে। পুলিশ সুপার বলেছেন, ‘‘ওই দু’জন ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি।’’

ওই ঘটনার পর প্রায় ১২ ঘন্টা কেটে গেলেও মামুদ এমন কাণ্ড করতে পারে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বিশ্বাস করতে পারছেন না। দক্ষিণ দিনাজপুরের তপন থানার ওই চক নেদইর এলাকার একাংশ বাসিন্দার সন্দেহ অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন ঘরের মেয়ে সুমনার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েই গরিব ঘরের মামুদ বেপরোয়া হয়ে ওই চরম সিদ্ধান্ত নেয়। কুমারগঞ্জের ডাঙারহাটের বেসরকারি মাদ্রাসার সম্পাদক সেকেন্দার চৌধুরীর কথায়, ‘‘মামুদের মধ্যে আমরা কোনও অস্বাভাবিকতা দেখিনি। এমন একটা কাণ্ড করবে ভাবতে শিউরে উঠছি।’’

বালুরঘাট হাসপাতালের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ঋতব্রত চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘সমাজে এ এক জটিল সমস্যা। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অ্যাসিড ছুড়ে মারা, ছুরি মেরে প্রেমিকাকে খুন করার পিছনে দেখা গিয়েছে, অভিযুক্তদের অধিকাংশ শৈশব থেকে অবহেলায় মানুষ হওয়ায় তাঁদের মধ্যে হতাশা নেমে আসে। এদের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কম হয়। অতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে সাংঘাতিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারাও অসম্ভব নয়।’’ চাইল্ড লাইনের জেলা সমন্বয়কারী সূরজ দালের কথায়, না পাওয়ার অবসাদ থেকে এরা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। শুনেছি এ ক্ষেত্রে তার সামাজিক অবস্থান এবং মেয়েটির অবস্থানের মধ্যে পার্থক্য তার মনের হীনমন্যতাই উগ্র করে তুলতে পারে। অভিযুক্ত মামুদের ক্ষেত্রে ওই সমস্যা কতটা ছিল, তা ঘনিষ্ঠ জনেরা ভালো বলতে পারবেন। তবে অবসাদ, অবহেলা সইতে না পেরে ওই ধরনের যুবকদের মরিয়া হয়ে ওঠার বহু নজির রয়েছে।

গ্রামের সম্পন্ন কৃষক পরিবারের মেয়ে সুমনার চেয়ে সব দিক দিয়েই অপেক্ষাকৃত দুর্বল পরিবারের যুবক মামুদ ছোট বেলায় বাবাকে হারায়। সুমনার কাকারাও সম্পন্ন চাষি। এলাকায় তাঁদের দাপট রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। অন্য দিকে তাঁর বিধবা মা সামান্য চাষের জমি লিজে চাষ করিয়ে কোনও মতে সংসারের হাল ধরেন। বড় মেয়ে মাসুদার বিয়ের পর অভাবের কারণে বড় ছেলে মামুদকে নিখরচার ওই মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। ছোট থেকেই বাড়ি থেকে দূরের ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হস্টেলে থেকে মানুষ মামুদ। প্রতিবেশী সুমনা প্রথম দিকে তাঁকে পছন্দই করত বলে জানা গিয়েছে। পরে সে বেঁকে বসে বলে জানা গিয়েছে। তাতেই কি মরিয়া হয়ে মামুদ প্রেমিকাকে মেরে নিজেও আত্মঘাতী হয়েছে? উত্তর খুঁজছে পুলিশ।

tapan couple murde couple murder tapan youth suicide youth killed ladylove
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy