Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

কাজের প্রশংসা, জুটল মৃদু ধমকও

কোথায় শৌচাগার খারাপ। কোথায় মিড-ডে মিল বন্ধ— জেলার সব কিছুর খবর রয়েছে তাঁর কাছে! মঙ্গলবার দুপুরে রীতিমতো আটঘাট বেঁধেই বীরভূমে প্রশাসনিক বৈঠকে যোগ দিতে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিছু ক্ষেত্রে মৃদু ধমক খেলেও শেষমেশ বরাবরেই মতো এ বারও জেলা প্রশাসনের কাজে নিজের সন্তোষ প্রকাশ করলেন তিনি।

বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলন।

বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলন।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৫ ০১:৩০
Share: Save:

কোথায় শৌচাগার খারাপ। কোথায় মিড-ডে মিল বন্ধ— জেলার সব কিছুর খবর রয়েছে তাঁর কাছে!

মঙ্গলবার দুপুরে রীতিমতো আটঘাট বেঁধেই বীরভূমে প্রশাসনিক বৈঠকে যোগ দিতে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিছু ক্ষেত্রে মৃদু ধমক খেলেও শেষমেশ বরাবরেই মতো এ বারও জেলা প্রশাসনের কাজে নিজের সন্তোষ প্রকাশ করলেন তিনি। বেঠকে উপস্থিত জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলছেন, ‘‘এ দিন বোলপুরে গীতাঞ্জলিতে প্রশাসনিক বৈঠকে আগাগোড়া ভাল মেজাজেই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আমাদের কাজে মোটের উপরে খুশিই হয়েছেন তিনি। কোনও দফতরের কাজে অখুশি হলে সেই দফতরের কর্তা বা সচিবকে তুলে মৃদু ধমক দিয়েছেন মাত্র।’’ যে সূচক নিয়ে নাড়াচাড়া করলে একটি জেলার প্রকৃত উন্নয়ন বোঝা যায়, প্রতিটি দফতরকে ধরে ধরে ঠিক সেই সেই বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে দাবি ওই কর্তার। তাঁর কথায়, ‘‘দিদি যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেই আমাদের জেলায় এসেছিলেন!’’


চলছে সওয়াল জবাব।

এ দিন দুপুর পৌনে ১টা নাগাদ বোলপুরের সার্কিট হাউস থেকে পায়ে হেঁটে বোলপুরের গীতাঞ্জলি প্রেক্ষাগৃহে যান মুখ্যমন্ত্রী। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনের উদ্দেশ্যে নমস্কার করেন। লাগোয়া একটি ফলের দোকানের বিক্রেতা খোকন কুমারের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘সব ঠিক আছে তো?’’ এর পরেই তিনি প্রশাসনিক বৈঠকে বসেন। জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের ছোট থেকে বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পৌনে ১টা থেকে প্রায় ২টো ১০ পর্যন্ত প্রশাসনিক বৈঠক করেন তিনি। বৈঠকে এলাকার নির্বাচিত জন প্রতিনিধিরা হাজির ছিলেন। ছিলেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিরাও। তবে বিরোধী দলের কোন বিধায়ক বা জনপ্রতিনিধিকে এ দিন অবশ্য বৈঠকে দেখা যায়নি। হাজির ছিলেন না জেলার দুই সাংসদও। অসুস্থতার কারণে হাজির হতে পারেননি লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম।

সূত্রের খবর, এ দিন নানা বিষয় নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন তিনি। ধরে ধরে বিভিন্ন জনকে দাঁড় করিয়ে রীতিমতো জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী যেমন জানতে চান, অমুক স্কুলের মিড-ডে মিল বন্ধ কেন। কেন ১০০ শতাংশ স্কুলে মিড-ডে মিল চলবে না। জানতে চেয়েছেন, ডিজিটাল রেশন কার্ডের অগ্রগতি কোন পর্যায়ে চলছে। প্রশাসনের কর্তা জানান, ৯২ শতাংশ কাজই হয়ে গিয়েছে। যা শুনে মমতা আগামী এক মাসের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি জেলায় প্রসূতি, গর্ভবতীরা জননী সুরক্ষার টাকাপয়সা ঠিকমতো পাচ্ছেন কিনা, শিশুদের টিকাকরণ কর্মসূচি কেমন হচ্ছে, হাসপাতালে পরিকাঠামোগত উন্নয়নে যে কাজ হওয়ার কথা, সেগুলি কোন পর্যায়ে— সমস্ত খোঁজ নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।


সাত্তোরের নির্যাতিতাকে মুক্তির দাবি।

বৈঠকে উঠে আসে বীরভূমে গত আর্থিক বর্ষে জেলায় গড়ে ৩৫ দিন ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ পেয়েছেন জবকার্ডধারীরা। এ বছর এখনও পর্যন্ত সেই হার ১৭ দিন। জানা গিয়েছে, একশো দিন প্রকল্পের কাজে আরও গতি এনে এ বছর কমপক্ষে ৫০ দিন কাজ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকে বীরভূমের বিভিন্ন নদীতে বালি চুরির ঘটনায় রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। অবৈধ ভাবে নদী থেকে বালি তোলার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাঁধ, সেতু। আবার অতিরিক্ত পাথর, বালি নিয়ে রাস্তার উপর গাড়ি চলাচল হওয়ায় রাস্তার অবস্থাও ক্রমে খারাপ হচ্ছে। এ সব আটকাতে জেলার পুলিশ সুপার এবং সংশ্লিষ্ট দফতরকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠকে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, ‘‘বালি চুরি ও ওভারলোডিং বন্ধ করতেই হবে। তার জন্য যত কঠোর হতে হয়, তা হতে হবে। এ দল দেখার কোনও দরকার নেই।” পাশাপাশি দেউচা-পাঁচামী কোল মাইন্স যাতে তাড়াতাড়ি হয়, সে জন্য মুখ্যমন্ত্রী মিনারেল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রশাসনিক কর্তাদের। সেই সঙ্গে তালিত, ভেদিয়া এবং সিউড়িতে জাতীয় সড়কে রোড ওভারব্রিজ তৈরির বিষয়টি কতটা এগিয়েছে, এবং তা দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার ব্যাপারে পূর্ত দফতরের সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের পক্ষে এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার নীরজ সিংহকে রাস্তা সড়ক সংস্কারের নজর দিতে অনুরোধ করেছেন।

এ দিন একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথাও প্রশাসনিক বৈঠকে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। জেলার বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র, যেমন পাঁচপীঠ ও তারাপীঠ-সহ একটি বাস সার্কিট চালু করার প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। যার নাম হবে ‘মাতৃ দর্শন’। তিলপাড়া, গণপুর ও বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জলাধারের মতো কয়েকটি জায়গা বেছে নিয়ে ‘ইকো ট্যুরিজম স্পট’ করার ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে। ৯ কোটি টাকা ব্যায়ে তারাপীঠে মেগা ট্যুরিজম প্লানের অনুমোদন দিয়েছে পর্যটন দফতর। সম্প্রতি তারাপীঠ ও শান্তিনিকেতন নতুন থানা হওয়ার ঘোষণা হয়েছে। এ দিন দ্রুততার সঙ্গে সেটা বাস্তবায়িত করার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং এর পরবর্তী ধাপে পাইকর, মল্লারপুর ও লোহাপুরেও নতুন থানা করার বিষয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। এ দিনই রামপুরহাটে বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পে ২৭২টি বাড়ি তৈরি জন্য প্রশাসনকে ২ কোটি ২৫ লক্ষ টাকার চেক দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পর্যটনের পাশাপাশি জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা জোরদার করার দিকেও তিনি নজর দিয়েছেন। সিউড়ি থেকে পাথরচাপুড়ি হয়ে কলকাতাগামী বাস যাতে রাজনগর ছুয়ে যেতে পারে বা খয়রাশোল থেকে বর্ধমানের মতো একাধিক নতুন বাসরুট চালু করার জন্য তিনি জেলাশাসককে দায়িত্ব দিয়েছেন।


আনন্দবাজারে ছবি প্রকাশিত হওয়ার পরে রাতারাতি বদলে গেল মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকের ভুল বানানের ব্যাকড্রপ । —নিজস্ব চিত্র।

ঘটনা হল, মুখ্যমন্ত্রী বীরভূম সফরে এসে প্রশাসনিক বৈঠকে প্রায় প্রতি বারই প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের কাজ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ বারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বৈঠকে উপস্থিত এক প্রশাসনিক কর্তা বলেন, ‘‘ওই দফতরের কাজে খুশি হননি মুখ্যমন্ত্রী। এ জন্য মৃদু বকাঝকা শুনতে হয়েছে দফতরের কর্তা এবং সচিবকে। জেলায় গরিব মানুষদের স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে হাস, মুরগি ও ছাগল ছানা বিলি করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি উদ্যানপালন দফতরকেও কাজে গতি আনার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।’’ সূত্রের দাবি, এ দিন বৈঠকে উঠে এসেছে, জেলায় পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষদের জন্য নানা প্রকল্পের টাকা ঠিকমতো খরচ হয়নি। এখনও অনেক টাকা জেলায় জমা রয়েছে। তা শুনে ক্ষুব্ধ হন মুখ্যমন্ত্রী। কী কারণে ওই টাকা খরচ হয়নি, তা জানতে চান। কিন্তু, জেলা প্রশাসনের কেউ-ই যুক্তি সঙ্গত ব্যাখা দিতে পারেননি বলেই দাবি। ওই টাকার যাতে শীঘ্রই সদব্যবহার করা হয়, তাঁর জন্যও মুখ্যমন্ত্রী জেলাশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রশাসনিক বৈঠক সেরে এ দিন বেশ কিছু প্রকল্পের উদ্বোধন ও শিলান্যাস করেন মুখ্যমন্ত্রী। বোলপুর ব্লকের বিনোদপুর সেতু নির্মাণ, সাঁইথিয়া ব্লকের হরিসড়ায় পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্প-সহ ১৮টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তিনি। বোলপুরের সরকারি পলিটেকনিক কলেজ, তারাপীঠ বাসস্ট্যান্ডে যাত্রী প্রতীক্ষালয় এবং অন্যান্য প্রকল্প-সহ ১০টির শিলান্যাস করেন তিনি। জেলার উন্নয়নমূলক কাজ দ্রুত শেষ করার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী ফের বীরভূমে আসার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। জানিয়েছেন, আগামী ৬ জানুয়ারি মাসে বীরভূমে এক সপ্তাহের একটি বাউল মেলা হবে। সেই মেলার উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী।

ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE