Advertisement
E-Paper

যজ্ঞে পূর্ণাহুতি ‘প্রধান যজমান’ হয়ে, দ্বারোদ্ঘাটনও তাঁর হাতে, দিঘায় মমতার সমারোহ পাল্লা টানছে মোদীর অযোধ্যার সঙ্গে

দিঘায় পদার্পণ করেই মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, ‘বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে...।’ ১৫ মাস আগে ঠিক একই ভাবে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা ছিল— ‘৫০০ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে।’

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ২২:২৬
Mamata Banerjee to take part in Yagna, to open temple doors for common people herself, Digha resembles Ayodhya before Jagannath Temple inauguration

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

একজনের জগন্নাথ শরণ টেনে আনছে আর এক জনের রামভজনার স্মৃতি। লোকসভা ভোটের কয়েক মাস আগে গোটা দেশের নজর কেড়ে নিয়ে একজন রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর দূরে দাঁড়িয়ে আর এক জন মহাসমারোহে জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা করছেন। ঘটনাচক্রে, আয়োজকরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুযুধান।

বুধবার, অক্ষয়তৃতীয়ার দিন উদ্বোধন দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের (যাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘জগন্নাথধাম’ বলা হচ্ছে)। সোমবার দিঘায় পদার্পণ করেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার্তা দিয়েছেন, ‘বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে...।’ ১৫ মাস আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বার্তা ছিল, ‘৫০০ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে।’ মমতা এখন জগন্নাথের অপেক্ষায়। মোদী ছিলেন রামলালার অপেক্ষায়। রাম যাঁর অবতার, জগন্নাথও সেই বিষ্ণুরই রূপ। অর্থাৎ ভারতের প্রধানমন্ত্রী অযোধ্যায় যাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও দিঘায় তাঁরই মন্দির বানাচ্ছেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার পরে অযোধ্যার সমৃদ্ধি বাড়বে বলে ভারত জুড়ে প্রচার চালিয়েছিল বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার। জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠার পরে দিঘাতেও তেমনই ঘটবে বলে গোটা রাজ্যে তৃণমূল এবং সরকার জানাচ্ছে। প্রতি পদক্ষেপে মিল। এমনকি, মিল অমিলেও। অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার সময়ে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন মমতা। দিঘায় জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় মুখ ফিরিয়ে রেখেছে বিজেপি।

মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠমহলের বক্তব্য, তিনি কারও সঙ্গে কোনও প্রতিযোগিতায় যাচ্ছেন না। তিনি বাংলার মানুষের জন্য সমুদ্রের তীরের এই শহরে জগন্নাথের মন্দির তৈরি করেছেন। রাজ্যের মানুষের চাহিদা এবং দাবি মেনেই তিনি ওই কাজে হাত দিয়েছিলেন এবং কোভিডের সময়কার কর্মহীনতা সত্ত্বেও বছর পাঁচেকের মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। অক্ষয়তৃতীয়ায় বিগ্রহের প্রাণপ্রতিষ্ঠা এবং মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেই নির্ঘন্ট মেনেই কাজ এগিয়েছে। সম্পূর্ণও হয়েছে।

দিঘার নবনির্মিত মন্দিরে গত শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) থেকেই যাগযজ্ঞ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রথমেই যজ্ঞ হয়েছে বাস্তুপুরুষের উদ্দেশে। সে যজ্ঞের লক্ষ্য হল নবনির্মিত কাঠামোকে অপদেবতা বা অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত করা। যজ্ঞের পরে দেবতার প্রসাদ অর্পিত হয়েছে অপদেবতার উদ্দেশে। অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার সময়েও অপদেবতা-প্রসঙ্গ টেনে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন এক শঙ্করাচার্য। রামমন্দিরের নির্মাণকাজ তখনও সম্পূর্ণ হয়নি এবং অসম্পূর্ণ কাঠামোয় অপদেবতার অবস্থান হয়, দেবতা বিরাজ করেন না বলে মন্তব্য করেছিলেন হিন্দু ধর্মীয় কাঠামোর সর্বোচ্চ পদাধিকারী। পাল্টা যুক্তিও এসেছিল। যেখানে রামলালার বিগ্রহ স্থাপিত হবে, মন্দিরের সেই মূল অংশ তথা গর্ভগৃহের নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ করার পরেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা হচ্ছে বলে মন্দির নির্মাতা তথা রামজন্মভূমি আন্দোলনের পুরোধা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তরফে জানানো হয়েছিল।

দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে কিন্তু কোনও ‘অসম্পূর্ণতা’ নেই। পুরো কাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ। কিন্তু বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা একে ‘মন্দির’ বলতে নারাজ। রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এবং বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কণ্ঠেও একই সুর। সকলেরই একযোগে দাবি, ‘মন্দির’ বলা হলেও সরকারি নথিতে তা ‘সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’। আরএসএস বলছে, পর্যটনকেন্দ্র কখনও তীর্থক্ষেত্র হতে পারে না। কারণ পর্যটনকেন্দ্র তৈরি করা যায়, তীর্থক্ষেত্র কেউ তৈরি করতে পারে না। কিন্তু বিরোধী কণ্ঠস্বরের মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার লক্ষ্যে অবিচল। মহাসমারোহেই উদ্বোধনের তোড়জোড় চলছে, যে অনুষ্ঠান ঘিরে দিঘা এখন সরগরম। গোটা রাজ্যের নজর এবং উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দুও এই সৈকতশহর। যেমন ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে গোটা দেশ উৎসাহী এবং কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল অযোধ্যা নিয়ে।

অযোধ্যায় নবনির্মিত রামমন্দিরের উদ্বোধন হয়ে যাওয়ার পরে শহরের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে বলে বার বার দাবি করেছিল বিজেপি। রামভক্তদের আনাগোনায় অযোধ্যার পরিবহণ, হোটেল, লজ-সহ সব ব্যবসায় জোয়ার আসবে বলে দাবি করেছিলেন সরকারপন্থী অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা। ঝাঁ-চকচকে অযোধ্যা বিমানবন্দরের উদ্বোধন হয়েছিল। রেলস্টেশনের চেহারা বদলে গিয়েছিল। রাস্তাঘাট চওড়া হয়েছিল। দিঘাতেও জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনের আগে পরিকাঠামো ঝকঝকে, তকতকে। তবে অযোধ্যার মতো পরিকাঠামো বৃদ্ধির জন্য দিঘায় বুলডোজ়ার চালাতে হয়নি। জমি আন্দোলন করে রাজ্যে ক্ষমতায় আসা মমতা বিলক্ষণ জানেন, বুলডোজ়ার চালিয়ে জমি দখল করে মন্দির গড়লে তার ফল হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে দিঘা এখনও পর্যন্ত ফুরফুরে মেজাজেই। জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধনের পরে সেই আবহ আরও জোরালো হবে বলে রাজ্যের শাসক তৃণমূলের দাবি। রাজ্য সরকারও বলছে, মন্দির খুলে গেলেই দিঘায় ভিড় আরও বাড়বে। জোয়ার আসবে স্থানীয় অর্থনীতিতে।

নতুন মন্দিরে বুধবার জগন্নাথের মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা নিজে গোটা প্রক্রিয়ার সাক্ষী থাকবেন। তার জন্য মঙ্গলবার থেকেই তিনি যাগযজ্ঞে শামিল হবেন। প্রাণপ্রতিষ্ঠা তথা দ্বারোদ্ঘাটনের আগের দিন ‘মহাযজ্ঞে’ অংশ নেবেন মমতা। মঙ্গলবার সকাল থেকেই সে ‘মহাযজ্ঞ’ শুরু। শেষ পর্বে ‘প্রধান যজমান’ হিসেবে ষজ্ঞাগ্নিতে পূর্ণাহুতি দেবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা নিজেই। ঘটনাচক্রে, ২০২০ সালে যখন অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস হয়েছিল, তখন ‘প্রধান যজমান’ হিসেবে যজ্ঞে আহুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ২০২৪ সালে বিগ্রহে প্রাণপ্রতিষ্ঠার দিনেও মোদী ছিলেন সেই ‘প্রধান যজমানে’র ভূমিকায়। গর্ভগৃহে তাঁকে সঙ্গে নিয়েই পুরোহিতরা রামলালার বিগ্রহে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার পরে পদ্মফুল হাতে পদ্মাসনে বসে বিশেষ পূজায় অংশ নিয়েছিলেন মোদী। তবে দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের ক্ষেত্রে সেই ছবিটা অন্য রকম হবে বলেই খবর। প্রাণপ্রতিষ্ঠা, বিগ্রহের স্নান, বস্ত্র পরিধান এবং পরিশেষে ছাপ্পান্ন ভোগের আগে গর্ভগৃহে শুধু পুরোহিতরা ছাড়া কারও থাকার কথা নেই। ভোগ নিবেদনের পরে মুখ্যমন্ত্রীর হাত দিয়েই হবে আনুষ্ঠানিক দ্বারোদ্ঘাটন। তখন থেকেই সর্বসাধারণের জন্য খুলে যাবে জগন্নাথ মন্দির।

দ্বারোদ্ঘাটনের পর জগন্নাথ বিগ্রহের প্রথম আরতি মমতার হাতেই হবে। ঘটনাচক্রে, রামলালার বিগ্রহে প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর আরতি করেছিলেন মোদী।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে গোটা দেশ থেকে কেউকেটারা হাজির হয়েছিলেন অযোধ্যায়। দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিদের প্রায় সকলে, বলিউড তারকাদের সিংহভাগ, প্রভাবশালী সাধুসন্ত, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতারা, রামমন্দির আন্দোলনের পরিচিত মুখেরা (আডবাণী-যোশী বাদে)। কে ছিলেন না সেই জমায়েতে! ছিল দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজির বিপুল সাধারণ জনতা। দিঘায় মমতা সচেতন ভাবে সেই ‘ভিড়ভাট্টা’ এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। কারণ, মহাকুম্ভে বিপর্যয়ের স্মৃতি এখনও টাটকা। দিঘার জমায়েতের ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বাড়তি সতর্ক। সোমবার বিকেল থেকে দিঘায় ব্যক্তিগত গাড়ি ঢোকা নিয়ন্ত্রিত হয়ে গিয়েছে। সাধারণ জনতা শুধু নয়, নিজের দলের বহু কেউকেটাকেও মমতা দিঘা থেকে দূরে রাখছেন। সব নেতা বা জনপ্রতিনিধি ডাক পাননি। তারকা সাংসদ-বিধায়কেরা আমন্ত্রিত। যেমন সাংসদ জুন মালিয়া সোমবারই পৌঁছে গিয়েছেন সৈকতশহরে। বিধায়ক লাভলি মৈত্র পৌঁছোবেন মঙ্গলবার। মন্দির উদ্বোধনে উপস্থিত থাকতে পারেন তারকা-সাংসদ দেবও। মুখ্যমন্ত্রী আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাংলার প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতিদেরও। সোম এবং মঙ্গলে তাঁরা পৌঁছে যাচ্ছেন দিঘায়। উদ্বোধনের পরে বুধবার সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মন্দির সংলগ্ন এলাকায়। সেখানে ওড়িশি নৃত্যশিল্পী ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুষ্ঠান।

সোমবার দিঘায় পৌঁছেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মন্দির-পর্ব মিটিয়ে বৃহস্পতিবার কলকাতায় ফেরার কথা তাঁর। তত দিনে নিশ্চিত ভাবেই অযোধ্যা এবং দিঘার তুলনা-প্রতি তুলনা শুরু হয়ে যাবে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী চান বা না-চান।

Digha Jagannath Mandir Digha Jagannath Temple Ayodhya Ram Mandir CM Mamata Banerjee PM Narendra Modi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy