নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে সোমবার জোড়া তির ছুড়ল তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপির পাল্টা জবাব, তৃণমূলের আক্রমণে তাদের ‘ভয়’ই স্পষ্ট!
ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) পরিচালনায় প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে সামনে রেখে কমিশনের উদ্দেশ্য নিয়ে ফের প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) জ্ঞানেশ কুমারকে আবার চিঠি লিখে তাঁর প্রশ্ন, ‘ডেটা এন্ট্রি অপারেটর’ নিয়োগের নির্দেশ এবং বেসরকারি জায়গায় বুথ তৈরির সিদ্ধান্ত কি কোনও রাজনৈতিক দলের স্বার্থেই? আর দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে বলেছেন, দলীয় সাংসদেরা গিয়ে সিইসি-কে বুঝিয়ে দেবেন, এটা পশ্চিমবঙ্গ! বিহার নয়!
বিএলও-মৃত্যুর ঘটনায় চার দিন আগেই সিইসি-কে চিঠি লিখে এসআইআর প্রক্রিয়া স্থগিত করার দাবি জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ বার এসআইআর-এর জন্য রাজ্যে এক হাজার ‘ডেটা এন্ট্রি অপরাটের’ ও ৫০ জন সফ্টঅয়্যার ডেভেলপার’ নিয়োগ নিয়ে কমিশন ও রাজ্য সরকারের টানাপড়েনে ফের জ্ঞানেশকেই চিঠি লিখেছেন তিনি। কমিশন চেয়েছিল, এ ক্ষেত্রে স্থায়ী কর্মীদের প্রয়োজন আগামী এক বছর। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) দফতর জেলাশাসকদের চুক্তিভিত্তিক ‘ডেটা এন্ট্রি অপারেটর’ বা ‘বাংলা সহায়তা কেন্দ্রে’র থেকে এ কাজে কাউকে নিয়োগ করতে বারণ করেছিল। সিইসি-কে এ দিন লেখা চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চেয়েছেন, ‘জেলায় জেলায় পর্যাপ্ত সংখ্যক যোগ্য কর্মী থাকা সত্ত্বেও এক বছরের কাজের জন্য এই রকম এজেন্সি নিয়োগের প্রয়োজন কী? এটা কি একটি রাজনৈতিক দলের স্বার্থসিদ্ধির জন্য করা হচ্ছে?’
এরই মধ্যে পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুরে বাবলু হেমব্রম (৩২) এবং মুর্শিদাবাদে বেলডাঙায় কমল নন্দী (৫৩) নামে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। দুই পরিবারের দাবি, এসআইআর নিয়ে চিন্তায় ছিলেন দু’জনে। হুগলির বাঁশবেড়িয়ার তোরাফদিন আমন, পূর্ব মেদিনীপুরের কাটোয়ার শুকদেব দাস, উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার সুমনকুমার দাস নামে তিন বিএলও কাজের চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ। হাবড়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিএলও-র জায়গায় অন্য এক জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কমিশন-শাসক পক্ষ সংঘাতে বেসরকারি আবাসনে বুথ তৈরির নির্দেশ নিয়েও চিঠিতে প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি লিখেছেন, ‘এটা সমস্যাজনক। বুথ সব সময়েই সরকারি বা আধা-সরকারি জায়গায় হয়ে থাকে।’ মুখ্যমন্ত্রীর মতে, এই সিদ্ধান্ত নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতায় গুরুতর প্রভাব ফেলবে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর পাল্টা অভিযোগ, ‘‘রাজীব সিন্হার মতো এক জন দুর্নীতিগ্রস্তকে দিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করে মুখ্যমন্ত্রী পঞ্চায়েত-পুরসভা ভোটে লুট করেছিলেন। ভাবছেন, জাতীয় নির্বাচন কমিশনটাও তেমন! ওঁর এই ধরনের কথার মূল্য নেই।’’ মন্দিরবাজারে মিছিল করতে গিয়ে শুভেন্দুর মন্তব্য, “পিসি জেনে গিয়েছেন— মৃত, ভুয়ো, একাধিক জায়গায় নাম আছে, বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নাম ভোটার তালিকায় থাকবে না। সংখ্যাটা এক কোটির উপরে যাবে। পিসি বুঝে গিয়েছেন এ বার কঠিন লড়াই।’’ তাঁর কটাক্ষ, ‘‘পিসি তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছেন কেন? পায়ে কাঁটা ফুটে গিয়েছে!’’
মুখ্যমন্ত্রীর তোলা অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাজ্যের সিইও মনোজ আগরওয়াল অবশ্য বলেছেন, ‘‘ডেটা এন্ট্রি অপারেটর নিয়োগের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের। এখানে অভিযোগ হয়েছিল এক ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের বিরুদ্ধে। তাঁকে নিলম্বিত করা হয়েছে। তার পরেই এই সিদ্ধান্ত হয় এসআইআরের অনেক আগে। কমিশনই টেন্ডার করতে বলেছিল। অর্থ দফতরকে সেই প্রক্রিয়াটি পাঠানো হয়েছিল।’’ আবাসনে বুথ তৈরি নিয়ে সিইও-র বক্তব্য, ‘‘জাতীয় নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিইও এই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।’’
এরই পাশাপাশি এ দিন দলের সব স্তরের প্রায় ২৫ হাজার নেতা-কর্মীর সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে কমিশনের কাজকর্ম সম্পর্কে ‘কঠোর’ হতে নির্দেশ দিয়েছেন অভিষেক। তিনি বলেন, ‘কমিশন বিজেপির সহকারী হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু বোঝাতে হবে, এটা বিহার নয়’! সেই সঙ্গেই দিল্লিতে সিইসি-র কাছে ১০ জন দলীয় সাংসদের প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে বৈঠকে তিনি বলেন, ‘আত্মঘাতী বিএলও এবং ভোটারদের চিঠি ও ভিডিয়ো দিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে, কেন তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর হবে না’! সেই সঙ্গেই অভিষেক বলেন, ‘বিহার, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও দিল্লির সঙ্গে বাংলার ফারাক আছে। আমরা চুরি ধরব। লোকসভা ভোটের তুলনায় সব বুথে অন্তত একটি ভোট বাড়াবই’।
এর আগে কমিশনে দাবি জানাতে যাওয়া ঘিরেই দিল্লিতে তুলকালাম বেধেছিল দলের দুই সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মহুয়া মৈত্রের মধ্যে। দু’জনকেই এ বার প্রতিনিধিদলে রাখা হয়েছে। রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনের কথায়, ‘‘সীমান্ত পাহারার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। এসআইআর-এর সঙ্গে অনুপ্রবেশের প্রশ্নকে জুড়ে দিয়ে বিজেপি যে হইচই করছে, তার মানে তারা কি অমিত শাহের ব্যর্থতার দিকেই আঙুল তুলছে!’’ অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গেই সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, “হাকিমপুর সীমান্ত দিয়ে সম্ভবত এখনও পর্যন্ত ১২০০ জন ও-পারে গিয়েছেন। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা যদি ১০ হাজারও হয়, পশ্চিমবঙ্গের মোট ভোটারের নিরিখে তা শতাংশেই আসে না। অনুপ্রবেশকারীরা অবশ্যই চলে যাবেন। কিন্তু অনুপ্রবেশের সময় বিএসএফ, রাজ্য পুলিশ কী করছিল? তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন দালাল-গোষ্ঠী কী ভাবে এঁদের এনেছিল? এখন এঁদের কেন থানার হাতে দেওয়া হচ্ছে না?’’ আর তৃণমূলের কমিশনে দরবারের সূত্রে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলবল নিয়ে দিল্লি আসতেই পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাংলার মানুষ এখন তাঁদের প্রাক্তন করে দিতে চায়!’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)