ঋণের ফাঁস ক্রমেই পরিণত হচ্ছে মৃত্যুফাঁদে! শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ধীরে ধীরে সব রাজ্যই জড়িয়ে পড়ছে ঋণের জালে। কী করে তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তার উপায় খুঁজতে সব রাজ্যকে নিয়ে কলকাতায় সম্মেলন করার প্রস্তাব দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বৃহস্পতিবার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানান, বাম আমলের যে ঋণের বোঝা উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি পেয়েছিলেন, আগামী পাঁচ বছরে তা ভয়াবহ জায়গায় চলে যাবে। চলতি আর্থিক বছর থেকে আগামী পাঁচ বছরে সুদ-আসল মিলিয়ে রাজ্য সরকারকে শোধ করতে হবে আড়াই লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। ঋণের ওই ভার থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে বিরোধী দলগুলির সহায়তা চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী যখন এই কথা বলছেন, তখন বিরোধী বেঞ্চ থেকে প্রশ্ন ওঠে, ‘(কেন্দ্রের কাছে চাওয়া) প্যাকেজের কী হল?’ জবাবে ঈষৎ ঝাঁঝিয়ে উঠে মমতা বলেন, ‘‘এটা কোনও চ্যাংড়ামো মারার বিষয় নয়। খুব সিরিয়াস ঘটনা। বিরোধীদের বলব ব্যাপারটা বুঝুন এবং একযোগে কাজ করুন।’’ এর পরেই তিনি অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আগে ঋণে জর্জরিত রাজ্য ছিল কেরল, পঞ্জাব এবং পশ্চিমবঙ্গ। এখন প্রায় সব রাজ্যেরই এক দশা। ‘ডেট ট্র্যাপ’ এখন ‘ডেথ ট্র্যাপে’ পরিণত হয়েছে। তাই সব রাজ্যকে ডেকে এখানে সম্মেলন করুন। ঋণের ফাঁদ থেকে বের হওয়ার রাস্তা খোঁজা হোক।’’
ঋণের প্রশ্নে কেন্দ্রের কাছে দাবি আদায়ে রাজ্যগুলিকে একজোট করার ক্ষেত্রে তিনি যে নেতৃত্ব দিতে চান, তা এ দিন বিধানসভাতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা। ঘটনাচক্রে সারা দেশে অভিন্ন জিএসটি চালু করার জন্য রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে যে এমপাওয়ার্ড কমিটি তৈরি হয়েছে, এখন তার মাথায় রয়েছেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। রাজ্যের স্বার্থ সুরক্ষিত রেখে এই নতুন কর ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য সম্প্রতি কলকাতায় বৈঠকও ডেকেছিলেন তিনি। সেখানে হাজির ছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সেই বৈঠকে জিএসটি নিয়ে জট যে অনেকটাই কেটে গিয়েছে তা কবুল করেছেন জেটলি। এ বার ঋণের বোঝা কমাতে সব রাজ্যকে একজোট করার ডাক দিলেন মমতা। অনেকের মতে, এর মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলোর গুরুত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যেও এগোতে চান মমতা।
রাজ্যের পরিস্থিতি যে কতটা ঘোরালো তা-ও এ দিন বিধানসভায় ব্যাখ্যা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, গত পাঁচ বছরে সুদ আর আসল বাবদ মেটাতে হয়েছে ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা। পরের পাঁচ বছরে বেরিয়ে যাবে আরও অন্তত আড়াই লক্ষ কোটি টাকা। ‘‘বছরে গড়ে যদি ৫০ হাজার কোটি ধার শোধ করতেই চলে যায়, তা হলে কোথা থেকে উন্নয়ন হবে!’’ প্রশ্ন মমতার।
মুখ্যমন্ত্রীর আগেই এ দিন ঋণের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন বাম পরিষদীয় দলের নেতা সুজন চক্রবর্তী। তিনি অবশ্য নিশানা করেছিলেন তৃণমূল সরকারকেই। সুজনবাবু বলেন, ‘‘বামফ্রন্ট সরকার চলে যাওয়ার সময় ১ লক্ষ ৮৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ ছিল। যার মধ্যে ৭৬ হাজার কোটি টাকা ছিল বাজার থেকে নেওয়া। কিন্তু তৃণমূল জমানার পাঁচ বছরেই ঋণ নেওয়া হয়েছে ১ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা। যার সিংহ ভাগ বাজার থেকে ধার করা।’’
জবাবে মমতা জানান, আর্থিক দায়িত্ব এবং বাজেট নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে রাজ্য এখন আর যত খুশি ঋণ নিতে পারে না। কিন্তু বামেদের করে যাওয়া ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে বলেই রাজ্যের উন্নয়ন প্রতিপদে বাধা পাচ্ছে। এক ঋণ
শোধ করতে গিয়ে আরও ঋণ নিতে হচ্ছে। ঋণের ফাঁদ থেকে বেরোনো যাচ্ছে না। তার পরেও কন্যাশ্রী, খাদ্যসাথী, সবুজসাথীর মতো জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু রাখা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীরদাবি, ‘‘বাম জমানায় রাজ্য পরিকল্পনা খাতে ১৪ হাজার কোটিটাকা খরচ হতো, এখন সেই খরচ বেড়ে ৫৩ হাজার কোটিতে পৌঁছেছে।’’
ঋণের ফাঁদ থেকে বেরোনোর জন্য বিরোধীদের সহায়তা যেমন চেয়েছেন, তেমনই রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে প্রয়োজনে কেন্দ্রের সাহায্য চাইতেও যে দ্বিধা করবেন না, তা-ও এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যের জন্য সাহায্য চাইতে তিন-চার বার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছি। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছি বেশ কয়েক বার। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। উল্টে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে টাকা কেটে নিয়েছে কেন্দ্র। তবে এখনও রাজ্যের জন্য দরকার হলে কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা চালাতে আমি রাজি।’’
রাজ্যের অর্থ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, কেন্দ্রের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলা ছাড়া আর কোনও উপায়ও নেই। কারণ, ২০০৬ সালে পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করতে গিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত বাজার থেকে ব্যাপক ধার করা শুরু করেন। ১০ বছরের মেয়াদি সেইঋণের আসল শোধ করতে হবে ২০১৬-’১৭ সাল থেকে। এখন বছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ শোধ করতে হলেও দু’বছর পরেই তা ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে যাবে। এবং উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে প্রতি বছর। তখন কেন্দ্রীয় সাহায্য ছাড়া রাজ্য চালানোই কঠিন হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy