Advertisement
E-Paper

ভঙ্গ বঙ্গদেশ রঙ্গশালাতেই ভরা! অভিনেতাদের রাজনীতির মূল স্রোতে এনেছিলেন মমতা, এখন নেতাদের মুখে অভিনেতার রং

এ রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে অভিনয়ের জগতেও ‘আমরা-ওরা’ এসেছে। তৃণমূলের যে নেতা বা নেত্রীরা ছবিতে অভিনয় করছেন, তাঁরা কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মতো ঘোষিত বামপন্থী পরিচালকের ছবিতে জায়গা পেলে আশ্চর্য হতে হবে।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ০৯:০৮
Many actors have become public representatives of TMC, Recently several top TMC leaders have started acting

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

একবার কপট আক্ষেপে সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘মমতা দলটাকে রাধা স্টুডিয়ো বানিয়ে দিল!’’

তখন তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী অভিনয়জগৎ থেকে একের পর এক তারকাকে লোকসভা ভোটের টিকিট দিচ্ছেন। এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমান নির্ভুল প্রমাণিত করে তাঁরা জিতে যাচ্ছেন ভোটের ময়দানে অভিজ্ঞ এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠ রাজনীতিকদের হারিয়ে। দীর্ঘদিনের সাংসদ বাসুদেব আচারিয়াকে হারাচ্ছেন মুনমুন সেন। বিপক্ষের প্রতিষ্ঠিত বাম রাজনীতিককে হারিয়ে জিতছেন সন্ধ্যা রায়। জিতে যাচ্ছেন দেব। যাঁরা কোনওদিন সংসদীয় রাজনীতিতে আসবেন বলে ভাবেইনি পশ্চিমবঙ্গ।

পশ্চিমবঙ্গ-সহ মোটামুটি সারা দেশ এখন মেনে নিয়েছে যে, ভোটারদের নাড়ির স্পন্দন মোক্ষম বোঝেন মমতা। সুব্রত যতই ছদ্ম আক্ষেপ করুন, সেলুলয়েডের তারকাদের ভোটের ময়দানে নামিয়ে তৃণমূলের নেত্রী ফল পেয়েছিলেন। তিনি সেই ফর্মূলা থেকে সরে আসার তো কোনও কারণ দেখেনইনি, বরং দিনেকালে তৃণমূলের ভোট ময়দানে তারকাদের সংখ্যা আরও বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৬ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ১৮ বছরে নয়-নয় করেও ১৮ জন অভিনেতা-অভিনেত্রী সাংসদ-বিধায়ক হয়েছেন মমতার দাক্ষিণ্যে। দলের অন্দরে তাঁদের কাউকে কাউকে নিয়ে অনুযোগ-অভিযোগ থেকেছে। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা কম। যাঁদের নিয়ে বেশি অভিযোগ ছিল, তাঁদের ছেঁটে ফেলেছে তৃণমূল। বদলে এসেছেন তুলনায় ‘সিরিয়াস’ তারকারা। কিন্তু গ্ল্যামারের জগৎ থেকে তৃণমূলে ‘সাপ্লাই লাইন’ অক্ষুণ্ণ থেকেছে। তাঁদের মধ্যে শতাব্দী রায় ব্যতিক্রম। তিনি এখন অভিনেত্রী কম, নেত্রী বেশি। বাকিরা এখনও প্রথমে অভিনেতা বা অভিনেত্রী। পরে রাজনীতিক।

সম্প্রতি সেই একমুখী সাপ্লাই লাইন খানিক উভমুখী হচ্ছে। ঘটনাপ্রবাহ দেখে তেমনই মনে করছেন অনেকে। শাসক তৃণমূলের প্রতিষ্ঠিত, পরিচিত এবং লঘু অর্থে খানিক ‘র‌ংদার’ রাজনীতিকেরা মূলস্রোতের ছবিতে অভিনয় করছেন। যদিও আনুপাতিক হারে দু’পক্ষের কোনও তুলনাই হয় না। টলিউডের ১৮-র অনুপাতে অভিনয় করছেন মেরেকেটে চার-পাঁচ জন রাজনীতিক। তাঁদের ‘কাস্টিং ডিরেক্টর’-এর ভূমিকায় রয়েছেন রাজনীতিকে রূপান্তরিত দুই পরিচালক— ব্রাত্য বসু এবং রাজ চক্রবর্তী।

এর মধ্যে কি খানিক বলিউড-খ্যাত ‘নেপোটিজ়ম’-এর সোঁদা গন্ধ পাওয়া গেল?

কারণ, তৃণমূলের যাঁরা রাজনীতিক থেকে অভিনেতা হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাঁরা ছুটকোছাটকা ভূমিকায় বা পার্শ্বচরিত্রে সুঅভিনেতা হতে পারেন। কিন্তু ‘পেশাদার’ অভিনেতার নিক্তিতে দারুণ নম্বর পাবেন কি না, তা নিয়ে তাঁদের ঘনিষ্ঠেরাও খুব নিশ্চিত নন। আশ্চর্য নয় যে, এই নেতানেত্রীরা যাঁদের ছবিতে অভিনয় করছেন, তাঁরা সকলেই হয় অঙ্গাঙ্গি ভাবে নয়তো লতায়পাতায় তৃণমূলের সঙ্গে জড়িত। ব্রাত্য বা রাজ তো বটেই, পরিচালক অরিন্দম শীলও তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর ‘ঘনিষ্ঠতা’ গোপন রাখতে চান না। ঘটনাচক্রে, তৃণমূলের মুখপাত্র তথা রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ যে দু’টি ছবিতে পরপর অভিনয় করছেন, তাঁর একটির পরিচালক অরিন্দম, অন্যটির ব্রাত্য। প্রসঙ্গত, ব্রাত্যের ছবিতে অভিনয় করছেন তৃণমূলের বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামীও। নারায়ণের অভিনয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে, এমন কোনও খবর নেই। তবে কুণালের আছে। পেশায় এখনও সাংবাদিক কুণাল যৌবনে একটি বাংলা ধারাবাহিকে সাংবাদিকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এখনও তিনি যে দু’টি চরিত্রে তিনি অভিনয় করছেন, সেগুলিও তিনিই। ‘রাজনীতিক’ কুণাল অভিনয় করছেন রাজনীতিকের চরিত্রেই। তবে কিনা কুণালের উপমা শুধু কুণালই। সাংবাদিকতা, রাজনীতি এবং অভিনয়ের গণ্ডি পেরিয়ে কুণাল পুজোর সময়ে ঢুকেছিলেন মডেলিংয়েও। নিন্দকদের মুখে ছাই দিয়ে মডেল-সঙ্গিনী সমেত তাঁর ভিডিয়োর কোটি কোটি ‘ভিউ’ হয়েছে!

এ রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে অভিনয়ের জগতেও ‘আমরা-ওরা’ এসেছে। তৃণমূলের যে নেতা বা নেত্রীরা মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করছেন, তাঁরা কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মতো ঘোষিত বামপন্থী পরিচালকের ছবিতে জায়গা পেলে আশ্চর্য হতে হবে। তেমনই অবাক হতে হবে তৃণমূলের ‘ঘরের ছেলে’ পরিচালকদের ছবিতে অভিনেতা কিন্তু বিজেপি রুদ্রনীল ঘোষের ঠাঁই হলে। তাই স্বজনপোষণের সোঁদা গন্ধ এসে পড়ছে।

অভিনয় এবং রাজনীতির যোগাযোগ অবশ্য সুপ্রাচীন। অনেকে বলেন, রাজনীতিকেরাই নাকি সবচেয়ে ভাল অভিনেতা হন। তাঁদের রাজনীতিতে অভিনয়ই করতে হয়। অভিনেতারা সফল রাজনীতিক হন, এমন দৃষ্টান্তও নেহাত কম নেই। দক্ষিণ ভারতে এমজি রামচন্দ্রন, এনটি রামরাও থেকে জয়ললিতা— প্রত্যেকেই অভিনয়ের জগৎ থেকে রাজনীতিতে এসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রিত্ব করেছেন। তবে কোনও রাজনীতিক অভিনয়ে গিয়ে সেই শিখরে পৌঁছেছেন, এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

রাজ্যের শাসক তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে আগে মূলস্রোতের বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, আর কে, ‘কালারফুল’ মদন মিত্র। বছর দুয়েক আগে হরনাথ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘ওহ লাভলি’ ছবিতে অভিনয় করেন মদন। ‘ওহ্ লাভলি’ মদনেরই মুখনিঃসৃত চটুল লব্জ হিসাবে খ্যাত! তিনি যেখানেই যান, অনুরোধ আসে, ‘‘দাদা এক বার হয়ে যাক!’’ মদনও নিরাশ করেন না। হরনাথকেও নিরাশ করেননি। তবে সে ছবি বক্স অফিসে দারুণ ব্যবসা করেছে, এমন অভিযোগ নেই। সে উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল বলেও মনে হয় না। এ নেহাতই ক্ষমতাসীনকে রসেবশে রাখার নৈবেদ্য।

তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে নিয়মিত অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ছিল সাংসদ পার্থ ভৌমিকের। তিনি আগে থেকেই নাটকে অভিনয় করতেন। ফলে রাজ যখন তাঁকে তাঁর ‘আবার প্রলয়’ ওয়েব সিরিজ়ে নিয়েছিলেন, তখন স্বজনপোষণের গুঞ্জন শোনা যায়নি। তখন পার্থ রাজ্যের সেচমন্ত্রী। চরিত্র ছিল পুলিশ অফিসারের। পার্থের অভিনয় প্রশংসা পেয়েছিল। এমনকি, বিধানসভায় পার্থের সামনেই দলনেত্রী মমতা বলেছিলেন, ‘‘আমাদের মধ্যে থেকে কেউ যদি শিল্প-সাহিত্য জগতে ভাল কাজ করতে পারে, তাতে আমার আনন্দই হয়।’’

তৃণমূলের নেত্রীদের মধ্যে ইদানীং অনেকে ছবিতে কাজ করছেন কাউন্সিলর অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি অবশ্য রাজনীতিতে আসার আগে গ্ল্যামারজগতে ছিলেন। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতাও জিতেছিলেন। ঘরনি ছিলেন সদ্যপ্রয়াত অভিনেতা জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তবে আগে কখনও সিনেমায় অভিনয় করেননি। তাঁর ‘অভিনেত্রী’ জীবন শুরু হয়েছে রাজনীতিতে আসার পর। হিংসুটেরা অবশ্য বলে, অনন্যা মন্ত্রী তথা টালিগঞ্জের বিধায়ক অরূপ বিশ্বাসের বিশেষ ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদেই নাকি এত ছবিতে অভিনয় করেন। যদিও এ সবই রটনা। যেমন রটে থাকে। অনন্যাকে যাঁরা তাঁদের ছবিতে নিয়েছেন, তাঁরা শুধুমাত্র অভিনয় দক্ষতার কারণেই তাঁকে নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সমস্ত মহলের বক্তব্য। ওই মহলের আরও ব্যাখ্যা, অনন্যা শাসকদলের কাউন্সিলর এবং সফল রাজনীতিক হওয়ায় তাঁকে নিয়ে এসব অযথা রটনা করা হয়। এর সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং অনন্যা যে রাজনীতির কাজ করেও অভিনয়ের জন্য সময় বার করতে পারছেন, সে জন্য তাঁর প্রশংসা করা উচিত।

বেঁচে থাকলে সুব্রত মুখোপাধ্যায় সম্ভবত গোঁফের ফাঁকে তাঁর ট্রেডমার্ক মুচকি হাসিটা হেসে বলতেন, ‘‘মমতা রাধা স্টুডিয়োতেও তৃণমূলের শাখা সংগঠন খুলে দিল!’’

TMC Leaders TMC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy