Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Jhargrm

WB Municipal Election 2022: প্রাণের শহর অরণ্য সুন্দরী, পর্যটন বিশ্বে ঝাড়গ্রামের আরও পরিচিতি বাড়ুক

১৭৬৭ সাল পর্যন্ত ঝাড়গ্রামে স্বাধীন স্বশাসিত রাজা মল্লদেবের সাম্রাজ্য বিরাজ করে। এর পর ব্রিটিশ শক্তি পরবর্তী সময়ে ১৭৯৩ সালে ‘জমিনদার ব্যবস্থা’ প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাজ শাসনব্যবস্থার অবলুপ্তি করে।

অরণ্য সুন্দরী

অরণ্য সুন্দরী —নিজস্ব চিত্র।

প্রণব সাহু
প্রণব সাহু
শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৬:০৪
Share: Save:

দক্ষিণবঙ্গের যে ক’টি প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘেরা এবং আকর্ষণীয় জায়গা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ঝাড়গ্রাম। এ শহর কেবলমাত্র প্রকৃতির শহর বা অরণ্য সুন্দরী নয়। এ শহর ইতিহাস বিজড়িত ঐতিহ্যবাহী রাজা মল্লদেবদের রাজ শাসনব্যবস্থার এক সময়ের রাজধানী। ঝাড়গ্রাম শহর গড়ে ওঠার পিছনে এক ইতিহাস রয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে অর্থাৎ ১৫৯২ সাল নাগাদ রাজস্থানের অম্বররাজ সোয়ান মান সিংহ বাংলায় এসেছিলেন। তার মূল কারণ ছিল, আকবরের মুঘল সাম্রাজ্য পূর্ব ভারতে বিস্তার। সেই সময় রাজপুতানা ও মুঘল সাম্রাজ্য যৌথ ভাবে পূর্ব ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য সর্বেশ্বর সিংহ নামে এক সেনা আধিকারিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যে অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তা ছিল জঙ্গলখণ্ড। যদিও আইন-ই-আকবরিতে এর নাম ছিল ঝাড়িখণ্ড। যেখানে সাঁওতাল, মুন্ডা, ভূমিজ, কুড়মি, মাহাতো এবং লোধা সম্প্রদায়ের মতো আদিম অধিবাসীদের বাস।

১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সালের মধ্যে মরাঠারা যখন বাংলা আক্রমণ করতে আসে, তখন ঝাড়গ্রামের রাজা মান গোবিন্দ মল্লদেব ও বিষ্ণুপুরের রাজা এবং বাংলার নবাব যৌথ ভাবে মরাঠাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তাতে তাঁরা জয়লাভ করেন। এবং ১৭৬৭ সাল পর্যন্ত ঝাড়গ্রামে স্বাধীন স্বশাসিত রাজা মল্লদেবের সাম্রাজ্য বিরাজ করে। এর পর ব্রিটিশ শক্তি পরবর্তী সময়ে ১৭৯৩ সালে ‘জমিনদার ব্যবস্থা’ প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাজ শাসনব্যবস্থার অবলুপ্তি করে।

আইন, বিচার ব্যবস্থা এবং সামরিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলি ব্রিটিশদের হাতে চলে গেলেও দেওয়ানি ব্যবস্থা, রাজস্ব আদায়,আঞ্চলিক ও নগর পরিকল্পনা, সামাজিক উন্নয়ন, প্রজাদের কল্যাণমূলক কাজ— এ সব কিছু ঝাড়গ্রামের রাজপরিবারের হাতে ছিল। রাজা রঘুনাথ মল্লদেব ও রাজা নরসিংহ মল্লদেব বিংশ শতকের প্রথম থেকে মধ্য ভাগ পর্যন্ত ঝাড়গ্রাম শহরের পরিকল্পনা ও রূপায়ণ করেন। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ক্লাব, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বিনোদন কেন্দ্র, পুষ্করিণী, জলাশয়, রাস্তাঘাট,পয়প্রণালী, শ্মশান, কবরস্থান— রাজা নরসিংহ মল্লদেব বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এ সবের বাস্তবায়ন করেন।

 ঝাড়গ্রাম পুরসভা।

ঝাড়গ্রাম পুরসভা। —নিজস্ব চিত্র।

শাল, পলাশ, মহুয়া গাছের ঘেরাটোপে খরস্রোতা নদী, পাহাড়, টিলা, লালমাটি এবং উপজাতিদের এক বিশেষ লোকসংস্কৃতি নিয়েই ঝাড়গ্রাম শহরের পরিবেশ। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ও লোকসংস্কৃতির পীঠস্থান নয়, ঝাড়গ্রামের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ঐতিহ্যপূর্ণ মল্লদেব রাজপরিবার। এই পরিবার ঝাড়গ্রামের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে প্রায় ৩৬০ বছর ধরে। রাজ পরিবারের বংশপরম্পরায় আজও স্বমহিমায় তার ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে। সামগ্রিক ভাবেই ঝাড়গ্রাম এক বিশেষ আকর্ষণীয় স্থান। দক্ষিণবঙ্গের উল্লেখযোগ্য আকর্ষণীয় পর্যটনস্থান। ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশা সীমানা থেকে যথাক্রমে প্রায় ২৫ এবং ৩৫ কিলোমিটার দূরে। অর্থাৎ ঝাড়গ্রাম শহরটি পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ডের সীমানাঘেঁষা একটি জনপদ।

ঝাড়গ্রাম পুরসভার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:

১. স্থাপিত ১৯৮২
২. ওয়ার্ড সংখ্যা ১৮
৩.আয়তন ২১.৪ বর্গ কিলোমিটার
৪.জনসংখ্যা ৬১,৬৮২ (২০১১)
এই মুহূর্তে পুর-জনসংখ্যা প্রায় ৯০ হাজারেরও বেশি।
৫.জনঘনত্ব ২৮৮ /বর্গ কিলোমিটার
৬.বস্তি এলাকা ৩৯
৭.বস্তি এলাকার জনসংখ্যা ২১,৩৯৫
৮.জলের ট্যঙ্ক ২
৯.গভীর নলকূপ ২১
১০.মাঠ ২৮
১১.অবসর ও শিশু উদ্যান ৯
১২.রাস্তা ২৩১ কিলোমিটার
১৩.বিদ্যালয় ৪৭
১৪.মহাবিদ্যালয় ২
১৫.প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় ৩
১৬.বাজার ৪
১৭.আবাসন ১০
১৮.স্বাস্থ্যকেন্দ্র ৩
১৯.উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র ৩২
২০.নার্সিংহোম ৬
২১.শ্মশান ৫
২২.কবর স্থান ৩
২৩.বাড়ির সংখ্যা ১৮,১০১
২৪.অফিস ২০
২৫.জল সরবরাহ ১,২২,২৭৭ লক্ষ গ্যালন (প্রতি দিন)
২৬. উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থ প্রায় ৭৫ টন (প্রতি দিন)

 কাছেই ঝাড়গ্রাম স্টেশন

কাছেই ঝাড়গ্রাম স্টেশন —নিজস্ব চিত্র।

ঝাড়গ্রাম শহরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য তার গ্রামীণ পরিবেশ— ফাঁকা ফাঁকা বসত বাড়ি, চওড়া রাস্তাঘাট ,কিছু কিছু লাল মাটির মেঠো পথ, চার দিকে ঘন জঙ্গল এবং জঙ্গলের নানা বনফুল সেই সঙ্গে দূষণমুক্ত পরিবেশ ও স্বাস্থ্যকর পানীয় জল। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ঝাড়গ্রামে কংক্রিটের জঙ্গল তৈরি হয়েছে। মূলত ২০১১-য় পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরবর্তী সময়ে এবং ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল ঝাড়গ্রামের জেলা শহর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য— নানা ক্ষেত্রে পরিষেবা প্রদান ও বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যকলাপ ও আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য জমি ব্যবহারের পরিবর্তন দেখা যায়। প্রয়োজনের তাগিদেই কিন্তু কাঠামো ও পরিকাঠামোগত এই উন্নয়ন। তার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের কিছুটা আকর্ষণ কমেছে।

ঝাড়গ্রামবাসীর সমস্যা:

১. পরিবেশ দূষণ: গাছপালা নিধনের পাশাপাশি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল স্টেশন এলাকা থেকে ওঠা-নামা করার ফলে শহরের বিস্তৃত এলাকায় বায়ু ও শব্দদূষণ নিয়মিত ব্যাপার।
২. নিকাশি ব্যবস্থা: সাম্প্রতিক সময়ে বর্ষাকালে বেশি বৃষ্টি হলে জল জমে যায়।
৩. জলের সঙ্কট: শহরের জনসংখ্যার চাপ ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে নিয়মিত কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জলের জোগান অপ্রতুল।
৪. বর্জ্যপদার্থের ব্যবস্থাপনার অভাব: প্রতি দিন শহরের জৈব বর্জ্যের পরিমাণ প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ টন। সে সব সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব আছে।
৫. যানজট ও ট্রাফিক সংক্রান্ত সমস্যা: শহরের আয়তন খুবই কম। অথচ সড়ক পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৩১ কিলোমিটার। শহরের মাঝখান দিয়ে রাজ্য সড়ক গিয়েছে। তা ছাড়া বাস, লরি, ছোট গাড়ি, মোটরসাইকেল, টোটো ও অন্যান্য মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজারের বেশি গাড়ি চলাচল করে।
৬. পথবাতির অভাব: শহরের মোট পথের দৈর্ঘ প্রায় ২৩১ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার ছোট (ঢালাই ও মোরাম) রাস্তা। প্রান্তিক এলাকার রাস্তাগুলিতে পথবাতির অভাব আছে।
৭. উন্মুক্ত ও খোলা বাজারের অভাব: ঝাড়গ্রাম শহরের মুল বাজার অর্থাৎ জুবলি মার্কেট খুব ঘিঞ্জি, অস্বাস্থ্যকর এবং বদ্ধ। যেখানে প্রতি দিন প্রায় ১২ হাজারেরও বেশি ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম হয়। এর বিকল্প বাজার নেই বললেই চলে।

নতুন পুরবোর্ডের কোন কোন দিকে খেয়াল রাখা উচিত—

১. স্থায়ী ও টেকসই নগর পরিকল্পনার মুল মানচিত্র প্রকাশ
২.শহরের ২৮টি মাঠের পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। সেখানে খেলার মাঠ, বিনোদন ও শিশু উদ্যান, সবুজ করিডর গড়ে তোলা হোক
৩. বিকল্প ও আধুনিক বাজার ও ফুড পার্ক গড়ে তোলা
৪. বায়ু ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ
৫. জৈব ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা
৬. জলের সমস্যা মেটানোর জন্য ভূপৃষ্ঠের এবং নদীর জল পরিশ্রুত করে পানীয় জলের উপযোগী করে তোলা এবং সরবরাহ করা
৭. গৃহস্থালী বর্জ্য জলকে পরিশ্রুত করে পুনরায় ব্যবহার করা র ব্যবস্থা গড়ে তোলা
৮. শহরের নিকাশি ব্যবস্থা ও পয়ঃপ্রণালী সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে গড়ে তোলা এবং নিয়মিত সংস্কার করা
৯. শহরের প্রাণকেন্দ্রে জেলা পাঠাগার ও পুর পাঠাগার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
১০. শহরকে যানজট মুক্ত রাখার জন্য বহির্সংযোগ ও আন্ত-সংযোগের আলাদা আলাদা করে রাস্তা তৈরি করা
১১. শহরের প্রান্তিক এলাকায় রাস্তার ধারে পথবাতি বসানো
১২. সৌর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পথবাতি
১২. শহরের গোশালাগুলিকে সুনির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাওয়া
১৩. প্লাস্টিকের ব্যবহার, জলের অপচয়, বর্জ্য পদার্থ সংগ্রহ, রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, গাছ লাগানো, ছাদে বাগান গড়ে তোলা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও বাড়ি বাড়ি স্বাস্থ্য বিষয়ক খবর নেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা শিবির ও বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করা
১৪. শহরে অবস্থিত স্থাপত্য, মূর্তিগুলিকে পরিছন্ন রাখা

আমাদের প্রাণের শহর অরণ্য সুন্দরী ঝাড়গ্রাম। পর্যটনে বিশ্বের কাছে তার আরও পরিচিতি ঘটুক। পর্যটক আসুক। সবুজ শহর আরও প্রাণ পাক। আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো পূর্ণতা পাক। নতুন পুরবোর্ডের কাছে এটাই চাওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE