E-Paper

শতবর্ষে অলচিকি, লিপি চেনাতে ভরসা দেওয়াল লিখনও

ভারত জাকাত মাঝি মাডওয়া জুয়ান গাঁওতা নামে একটি সাঁওতাল যুব সামাজিক সংগঠনের ওই কর্মসূচির পাশে দাঁড়িয়েছেন ঝাড়গ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক প্রণত টুডু।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:১৮
দেওয়ালে অলচিকি অক্ষরমালা লিখছেন চিকিৎসক প্রণত টুডু। ঝাড়গ্রামের শুকনিবাসা গ্রামে।

দেওয়ালে অলচিকি অক্ষরমালা লিখছেন চিকিৎসক প্রণত টুডু। ঝাড়গ্রামের শুকনিবাসা গ্রামে। নিজস্ব চিত্র।

এ বছর অলচিকি লিপি সৃষ্টির শতবর্ষ। অথচ এখনও এ রাজ্যে সাঁওতালি মাধ্যমে প্রাথমিকস্তরে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোটুকু গড়ে ওঠেনি বলে ক্ষোভ বিভিন্ন সাঁওতাল সামাজিক সংগঠনগুলির।

ঝাড়গ্রাম জেলায় সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত সাঁওতালি মাধ্যম প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ৮০টি। কিন্তু বাস্তবে ৩৫টি সাঁওতালি মাধ্যম প্রাথমিক স্কুল চলছে। বাকিগুলিতে বাংলা মাধ্যমেই পড়ানো হচ্ছে। ফলে, সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকার অনেক পড়ুয়া মাতৃভাষায় প্রাথমিকস্তরে পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ। এই পরিস্থিতিতে অলচিকি লিপির প্রসারে এগিয়ে এসেছেন সাঁওতাল সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও আদিবাসী সামাজিক যুব সংগঠনের সদস্যরা। অলচিকি লিপি সৃষ্টির শতবর্ষ উপলক্ষে সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রামে-গ্রামে চলছে লিপি চেনানোর কাজ। ওই সব গ্রামের দেওয়ালে বড় বড় করে সাঁওতালি অক্ষরমালা লেখা হচ্ছে। প্রতিটি অক্ষরের তলায় থাকছে বাংলা উচ্চারণ। এভাবেই দিনে-রাতে চলছে দেওয়ালে লিপি লেখার কর্মসূচি।

ভারত জাকাত মাঝি মাডওয়া জুয়ান গাঁওতা নামে একটি সাঁওতাল যুব সামাজিক সংগঠনের ওই কর্মসূচির পাশে দাঁড়িয়েছেন ঝাড়গ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক প্রণত টুডু। কাজের শেষে অবসর পেলেই প্রণত হাজির হচ্ছেন সাঁওতাল গ্রামে। সেখানে দেওয়ালে অক্ষরমালা লেখার পাশাপাশি, এলাকার পড়ুয়া ও বয়স্কদের দেওয়া হচ্ছে সাঁওতালি ভাষায় অলচিকি লিপির নানা বই। গ্রামে-গ্রামে গড়ে তোলা হচ্ছে ‘অলচিকি লিপি প্রসার কমিটি’।

ঊনিশ শতক পর্যন্ত সাঁওতালি ভাষার নিজস্ব কোনও লিপি ছিল না। দেবনাগরী, রোমান অথবা আঞ্চলিক স্তরে বাংলা, ওড়িয়ার মত লিপি ব্যবহার করা হতো। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার রায়রঙ্গপুর থানার ডহরাডিহির বাসিন্দা পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু ১৯২৫ সালে অলচিকি লিপি তৈরি করেন। নিজের সৃষ্ট লিপির প্রসারে আমৃত্যু কাজ করে গিয়েছিলেন রঘুনাথ মুর্মু। ২০০৩ সালে সাঁওতালি ভাষা সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়।

জঙ্গলমহলের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সংখ্যা বেশি। তা সত্ত্বেও প্রাথমিক স্তরে সাঁওতালি মাধ্যমের পর্যাপ্ত শিক্ষকই নেই এখানে। ২০১২ সালে অবিভক্ত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সাঁওতালি মাধ্যম প্রাথমিক স্কুলগুলির জন্য ৪১০ জন সাঁওতালি পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। যাঁদের বেশিরভাগই অলচিকি লিপিতে সড়গড় নন। পরে তাঁদের মধ্যে ৩১ জন পার্শ্বশিক্ষককে উচ্চ প্রাথমিক বা জুনিয়র হাইস্কুলে পাঠানো হয়। এখন ঝাড়গ্রাম জেলায় পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পুরোদস্তুর সাঁওতালি মাধ্যম জুনিয়র হাইস্কুলের সংখ্যা ৫টি। এছাড়া সাঁওতালি মাধ্যম হাই স্কুলের সংখ্যা ৯টি। এর মধ্যে ছ’টিতে সাঁওতালি মাধ্যম উচ্চ মাধ্যমিক স্তরও রয়েছে। ঝাড়গ্রাম জেলার কলেজগুলির মধ্যে একমাত্র লালগড় সরকারি কলেজে সাঁওতালি মাধ্যম রয়েছে। স্নাতকস্তরে পাস ও অনার্স কোর্সে কয়েকটি বিষয় সেখানে সাঁওতালি ভাষায় অলচিকি লিপিতে পড়ার সুযোগ পান পড়ুয়ারা। ঝাড়গ্রাম সাধু রামচাঁদ মুর্মু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে সাঁওতালি ভাষা পড়ানোর পাশাপাশি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শন এই তিনটি বিষয়ও সাঁওতালি ভাষায় অলচিকি লিপিতে পড়ানো শুরু হয়েছে।

এমন আবহে জঙ্গলমহলের কমপক্ষে দু’শো সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রামে অলচিকি লিপির প্রচার অভিযানের কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে জুয়ান গাঁওতা। ঝাড়গ্রাম জেলা থেকে শুরু হয়েছে সেই কাজ। ওই সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক প্রবীর মুর্মু বলছেন, ‘‘সাঁওতাল সম্প্রদায়ের প্রতিটি মানুষকে অলচিকি লিপিতে সাক্ষর করার লক্ষ্যে আমরা কর্মসূচি শুরু করেছি। চিকিৎসক প্রণত টুডু আমাদের সহযোগিতা করছেন।’’

প্রণত নিজে বলছেন, ‘‘সাঁওতালি ভাষার মেরুদণ্ড হল অলচিকি লিপি। সেই কারণেই গ্রামে–গ্রামে লিপি চেনানোর কর্মসূচি চলছে।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Jhargram

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy