Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Train accident

এক যুগ পরেও রেল লাইনের ধারে জ্ঞানেশ্বরীর কঙ্কাল

শুক্রবার সন্ধ্যায় ওড়িশার বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি উস্কে দিচ্ছে ১৩ বছর আগে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের নাশকতার স্মৃতি।

Jnaneswari Express coach still lying at the accident spot

পড়ে রয়েছে জ্ঞানেশ্বরীর কামরা। ফাইল চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩ ১০:১৬
Share: Save:

সেটা ছিল ২০১০। তারিখ ২৭ মে। মাওবাদী নাশকতায় তখন অশান্ত জঙ্গলমহল। গভীর সেই রাতে দোমড়ানো-মোচড়ানো রেলের কামরাগুলি থেকে ভেসে আসছিল আর্তস্বর। চারপাশ যেন মৃত্যু উপত্যকা। এ দিক সে দিকে ছড়িয়ে রয়েছে দোমড়ানো জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের কামরা আর নয়তো ধাক্কা লেগে সেই সব কামরার উপরে উঠে যাওয়া মালগাড়ির কামরাগুলো। যাত্রিবাহী এক্সপ্রেস ট্রেনটির উল্টে যাওয়া এস-৩, এস-৪, এস-৫, এস-৬, এস-৭ কামরায় আটক যাত্রীদের ক্ষীণ আর্তস্বরে খানখান হয়ে যাচ্ছিল চারপাশের নিস্তব্ধতা। কেউ চাইছিলেন জল, কেউ বাইরে বেরিয়ে আসার সাহায্যপ্রার্থী।

শুক্রবার সন্ধ্যায় ওড়িশার বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি উস্কে দিচ্ছে ১৩ বছর আগে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের নাশকতার স্মৃতি। ২০১০ সালের রাত দেড়টা নাগাদ ঝাড়গ্রামের সরডিহার রাজাবাঁধে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েছিল জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস। খড়্গপুর ছেড়ে প্রায় ঘন্টায় ৭০ কিমি গতিবেগে যাচ্ছিল হাওড়া থেকে মুম্বইগামী আপ জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস। ট্রেনের চালক বিভয়কুমার দাস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে বুঝতে পেরেই ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেছিলেন। ঠিক ওই সময়ে ডাউন লাইনে উল্টোদিক থেকে একটি মালগাড়ি চলে আসায় সংঘর্ষ এড়ানো যায়নি। যার ফলশ্রুতি, জ্ঞানেশ্বরীর ১৪৯ জন যাত্রীর মৃত্যু। শতাধিক যাত্রী আহত হন। কয়েকজনের অঙ্গহানিও হয়। মালগাড়িটির চালকও নিহত হন। আর এখনও ২৪ জন রেলযাত্রীর দেহ শনাক্ত হয়নি। ওই ২৪ যাত্রীর ডেথ সার্টিফিকেটও পাননি পরিজনরা। ফলে রেলের প্রতিশ্রুতি মতো ওই ২৪ জনের পরিবার চাকরিও পাননি।

সেদিন ঘটনাস্থলে পৌঁছে দুর্ঘটনার বীভৎসতা বুঝতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল সুর্যোদয় পর্যন্ত। দুর্ঘটনাটি রাত দেড়টা নাগাদ ঘটলেও মাওবাদী হানার শঙ্কায় রাত তিনটের কিছু পরে পৌঁছেছিল খড়্গপুর থেকে আসা প্রথম উদ্ধারকারী ট্রেন। কলাইকুন্ডা বায়ুসেনা ঘাঁটি থেকেও বাস ও মেডিক্যাল টিম নিয়ে পৌঁছেছিলেন সেনাকর্মীদের উদ্ধারকারী দল। গুরুতর জখমদের বায়ুসেনার কপ্টারে খড়্গপুর ও মেদিনীপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দিনভরের উদ্ধার কাজে মুখ্য ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছিল পুলিশ ও আধাসেনার যৌথবাহিনীকে।

রেলের একটি কামরায় আটকে ছিল দুই যমজ বোন সাত বছরের শিরিন ও শাম্মি। বহুক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করছিল তারা। শিরিন-শাম্মির বাবা-মা কামরা থেকে বেরোতে পারলেও দুই খুদে বোন বেরোতে পারেনি। গরমের ছুটিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে মুম্বইয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্য ট্রেনে রওনা দিয়েছিল শাম্মি আর শিরিন। ট্রেনের কামরায় প্রায় দশ ঘন্টা আটকে থাকার পরে বহু চেষ্টায় গ্যাস কাটার দিয়ে কামরা কেটে যখন দুই বোনকে উদ্ধার করা হল, তখন নিথর হয়ে গিয়েছে দু’জনেই। তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন ঘটনাস্থলে। সেদিনই উচ্চপদস্থ রেল কর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, নাশকতার কারণেই এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছিল। আপ লাইনের প্যানড্রোল ক্লিপ খুলে দেওয়াতেই বেলাইন হয়েছিল জ্ঞানেশ্বরীর কামরাগুলি। গাড়ি ভাড়া করে ট্রেন যাত্রীদের পরিজনরা চলে এসেছিলেন রাজাবাঁধে।

স্বজনহারানো আর্তনাদে বাতাস ক্রমেই ভারী হয়ে উঠেছিল। অবশেষে ৪৮ ঘন্টা পরে কামরার কঙ্কাল গুলো সরিয়ে রেল চলাচলও শুরু হল। শুধু দগদগে স্মৃতি নিয়ে এখনও এখনও লাইনের ধারে পড়ে রয়েছে জ্ঞানেশ্বরীর কামরার কঙ্কালগুলি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Train accident Jnaneswari Express
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE