মিছিল: পূজা-হত্যাকাণ্ডে সাজা ঘোষণার পর। হাঁটছেন পূজার বাবাও (মাঝখানে)। নিজস্ব চিত্র
নদীতে মাছ ধরে, মেলায় ভেলপুরির দোকান করে পাঁচ মেয়ে সহ সাতজনের সংসার কোনওরকমে চালাতেন অনন্ত ভুঁইয়া। বড় ও মেজ মেয়ের বিয়ে দিলেও সেজ মেয়ে পূজা-সহ তিন মেয়ের পড়াশোনা চালাতে প্রতি মুহূর্তে হিমসিম খেতে হত অনন্তবাবুকে। তমলুক শহরের উত্তরচড়া শঙ্করআড়ার বাসিন্দা ভুঁইয়া পরিবার আদতে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ডায়মন্ড হারবার এলাকার বাসিন্দা।
পেটের তাগিদে কাজের খোঁ৫০৩জে তমলুকে পরিবার নিয়ে চলে এসেছিলেন। রূপনারায়ণ নদের তীরে একচিলতে ঘর করে বসবাস শুরু করেন। এ দিন সাজা ঘোষণার পর কপালে হাত দিয়ে অনন্তবাবু বলেন, ‘‘ভিটে ছেড়ে না এলে হয়তো মেয়েটার এমন পরিণতি হত না।’’ জানালেন, সংসারে র আর্থিক টানাটানির জন্য রোজগারের আশায় পূজাকে ২০১২ সালের এপ্রিলে পরিচারিকার কাজে শালগেছিয়া এলাকার স্কুলশিক্ষক প্রণব রায়ের বাড়িতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মাস ঘুরতে না ঘুরতেই সেখান থেকে দুঃসংবাদ পান তিনি।
অনন্তবাবু বলেন, ‘‘ওই বছরেই ২৩ মে দুপুর একটা নাগাদ আমার বাড়িতে জানানো হয়, মেয়ে অসুস্থ হয়ে তমলুক হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। হাসপাতালে ছুটে গিয়ে দেখি মেয়ে অবস্থা সঙ্কটজনক। কিছুক্ষণ পরেই সে মারা যায়। আমাকে বলা হয়েছিল মেয়ে বিষ খেয়ে মারা গিয়েছে।’’
তিনি জানান, মেয়ে বিষ খেয়েছে এটা তাঁর বিশ্বাস হয়নি। সেটা যে মিথ্যা তা প্রমাণিত হয় তাঁকে টাকার লোভ দেখানোয়। অনন্তবাবুর দাবি, ‘‘মেয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে স্বীকার করে নিলে মোটা টাকা দেওয়া হবে বলে প্রলোভন দেখানো হয়েছিল শিক্ষকের পক্ষ থেকে। এমনকী আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার কয়েকদিন আগেও ওই শিক্ষক ৯ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখান। বলেছিলেন মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য। রাজি হইনি। মেয়ের খুনির বিচার চেয়েছিলাম।’’
পূজার মৃত্যুর ঘটনায় ধর্ষণ করে খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত শিক্ষক প্রণব রায়কে বৃহস্পতিবার পূর্ব মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক (দ্বিতীয়) ফাঁসির আদেশ দেন। এদিন আদালতে হাজির থাকা অনন্তবাবু রায় শোনার পর বেরিয়ে এসে বলেন, ‘‘মেয়েকে নৃশংসভাবে খুনের পরে ওই ব্যক্তি আমাকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে অভিযোগ না জানানোর জন্য বলেছিল। মামলা চলার সময়েও অনেক প্রলোভন দেখিয়েছে। কিন্তু খালি মেয়ের মুখটা মনে পড়ত। ওর মুখ চেয়ে খুনির কঠিন শাস্তি চেয়েছি। ফাঁসি চেয়েছি। এখন মনে হচ্ছে এই দিনটার জন্যই যেন এতদিন অপেক্ষা করছিলাম।’’
মেয়ের বিচার চেয়ে লড়াইয়ে নামা অনন্তবাবু বলেন, ‘‘আদালতে সরকারি আইনজীবীও খুব সাহায্য করেছেন। মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠনেরও সাহায্য পেয়েছি। এই সাজা শোনার আর কেউ এমন এমন কাজ করতে গিয়ে দু’বার ভাববে।’’ এই রায়ের বিরুদ্ধে কেউ উচ্চ আদালতে গেলে সেখানেও তিনি লড়বেন বলে জানান অনন্তবাবু।
এদিন আদালত চত্বরে হাজির মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেত্রী অনিতা মাইতি বলেন, ‘‘দরিদ্র একটি পরিবারের নাবালিকা মেয়েকে ধর্ষণ ও খুনের পরও দোষীব্যক্তি টাকার প্রলোভন দেখিয়ে অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। সেই প্রলোভন উপেক্ষা করে সন্তানহারা বাবা যেভাবে মেয়ের জন্য বিচার চেয়ে লড়াই করেছেন তা দৃষ্টান্তমূলক।’’
এ দিন শিক্ষকের সাজা ঘোষণার পর আদালত চত্বরে দাঁড়িয়েই পূজার ময়নাতদনন্তকারী চিকিৎসক প্রদীপ দাস বলেন, ‘‘নিহতের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বদলের জন্য নানা ভাবে আমার উপরে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এমনকী আমার বাড়িতেও হামলা চালানো হয়েছিল। কিন্তু কোনও চাপের কাছে মাথা নোয়াইনি।’’ তিনি জানান, আজ অনেকে এই সাজা ঘোষণার পর বাহবা দিলেও সেই সময় কেউ তাঁর পাশে দাঁড়াননি। তাঁর দাবি, ‘‘সেদিন ময়নাতদন্ত করে সঠিক রিপোর্ট দেওয়ার জন্যই দোষীর উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy