Advertisement
E-Paper

ইলিশের খোঁজে সমুদ্রযাত্রা শুরু

সমুদ্রের পাড়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকশো ট্রলার। রাতের অন্ধকারে টিমটিম করে জ্বলছে মাঝি নৌকা-ট্রলারের আলো। গায়ে নামাবলি জড়িয়ে ট্রলারের সামনে মঙ্গলচিহ্ন এঁকে দিচ্ছেন পুরোহিত। শাঁখ বাজাচ্ছেন, উলু দিচ্ছেন মৎস্যজীবী, মাঝি পরিবারের বাড়ির মেয়ে-বৌ।

সুব্রত গুহ

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৬ ০৭:১১
শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। সোহম গুহর তোলা ছবি।

শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা। সোহম গুহর তোলা ছবি।

সমুদ্রের পাড়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকশো ট্রলার। রাতের অন্ধকারে টিমটিম করে জ্বলছে মাঝি নৌকা-ট্রলারের আলো। গায়ে নামাবলি জড়িয়ে ট্রলারের সামনে মঙ্গলচিহ্ন এঁকে দিচ্ছেন পুরোহিত। শাঁখ বাজাচ্ছেন, উলু দিচ্ছেন মৎস্যজীবী, মাঝি পরিবারের বাড়ির মেয়ে-বৌ। কারও এক মুহূর্ত দম ফেলার ফুরসত নেই। আর ট্রলারে উঠে সমুদ্রে ভাসার প্রহর গুনছেন মৎস্যজীবীরা। সমুদ্রে ফুঁড়ে রুপোলি ফসল তুলে আনার এটাই যে মাহেন্দ্রক্ষণ!

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের শুরুতে যে ছবি এঁকেছিলেন, এই ছবি যেন সেটাকেই মনে করিয়ে দেয়। টানা দু’মাস পর বুধবার, ১৫ জুন উঠে গিয়েছে সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা। তাই বর্ষার শুরুতে ইলিশ ধরার সেই একই তৎপরতা দিঘা মোহনা, শঙ্করপুর, পেটুয়াঘাট, জলধা, নিউ জলধা, শৌলা, দাদনপাত্রবাড়, বগুড়ান জলপাই ও জুনপুট-সহ জেলার সমুদ্র উপকূলের মৎস্যজীবীদের।

সময় খুব দামি। তাই বুধবার নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ঠিক আগেই সমুদ্র মৎস্যজীবীরা সমুদ্রে ভেসে গিয়েছেন। বছরভর প্রস্তুতি থাকলেও গত সোমবার থেকে সাজো সাজো রব পেটুয়াঘাট মৎস্যবন্দর জুড়ে। মাছ শিকারের যাবতীয় সরঞ্জাম তোলা, ট্রলি ঠিক চলছে কি না তা বারবার দেখা, নৌকোর যাবতীয় সরঞ্জাম মজুত করা-এমনই কত কিছু। এই ভেসে যাওয়া তো শেষ হবে সপ্তাহান্তে। এর মধ্যে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিতে হয়। মরীচিকা ট্রলারের চালক গোবিন্দ প্রধান জানালেন, প্রতিটি ট্রলারে গড়ে ১৩ থেকে ১৫ জন করে জেলে, মাঝি ও ট্রলার চালক থাকেন। প্রথম সাত দিনের জন্য ১০ টন বরফ, ইলিশ ধরার জাল, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য অগ্নি নির্বাপক ফোম স্প্রে, লাইফ জ্যাকেট থাকেই। আর নিজেদের খাওয়ার জন্য মজুত করতে হয় চাল, আনাজপাতি, গ্যাস ওভেন মায় ওষুধপত্রও।

প্রতি বছর ১৫ এপ্রিল থেকে ১ জুন পর্যন্ত ৪৭দিন সমুদ্রে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু এ বছর সেই সময় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬১ দিনে। দু’মাস বাড়িতে বসে ছিলেন মেদাখালির গোবিন্দ প্রধান, ট্রলারকর্মী আকন্দির স্বপন বড়াই, পুলিন মণ্ডলরা। সোমবার থেকেই অপেক্ষা ছিল মাহেন্দ্রক্ষণের। স্বামীরা এত দিনের জন্য সমুদ্রে ভেসে বেড়াবেন—তাই তাঁদের মঙ্গলের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘটা করে হয়েছে গঙ্গা আর কালীপুজো। দিপালী পুতুল আর শিবানীদের কথায়, “এটাই তো সময়। যে যত বেশি মাছ পাবে, তারাই বেশি লাভের মুখ দেখবে। কিন্তু ভয়টাও যে যায় না!’’ তাঁরাই জানান, সমুদ্রে বিপদ ঠেকাতে মঙ্গল কামনায় বাড়িতে গঙ্গা পুজো করা হয়। পুজোর ফুল, ঘট নিষ্ঠাভরে বাড়িতে তুলে রাখা হয়েছে। অনেকে আবার প্রসাদী ফুল নিয়েই উঠেছেন নৌকায়।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ পুজোর ঘট নিয়ে পেটুয়াঘাটে গিয়ে ট্রলারে উঠেছেন মৎস্যজীবীরা। তার আগে পুজো করা হয়েছে ট্রলারে। নৌকা ধুয়ে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যেই ফুলমালা দিয়ে সাজানো হয়েছে। ঠাকুরের সিঁদুরের প্রলেপও লাগানো হয়েছে। মৎস্যজীবী সহদেব শ্যামল ও গৌতম শ্যামলের কথায়, ‘‘বুধবার সূর্যোদয়ের আগেই ট্রলার থেকে বাড়ির পুজোর ঘটফুল মা গঙ্গার উদ্দেশে ফেলে দেব। সমুদ্রে যাত্রা শুরুর জন্য এটা শুভ।’’

গত মরসুমে সমুদ্রে ইলিশের আকাল ছিল। কিন্তু এ বার মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার দিন বেশি থাকায় ভাল পরিমাণ ইলিশ মিলবে বলে মনে করছেন দিঘা ফিসারমেন অ্যান্ড ফিস ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সচিব শ্যামসুন্দর দাস। শ্যামসুন্দরবাবুর নিজেরও কয়েকটি ট্রলার রয়েছে। সেই ট্রলারগুলির সমুদ্রযাত্রার কাজে ব্যস্ততার মধ্যেই জানান, “এ বার আবহাওয়া একেবারে ইলিশের উপযোগী। কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টি দুটোই ভাল হয়েছে। সমুদ্রে জলের ও বাতাসের যথেষ্ট টানও রয়েছে। বাতাস আর জলের এমন যুগল টানেই সমুদ্রে ইলিশ মেলে ভাল।’’ পেটুয়াঘাট মৎস্যবন্দর সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যে ১১০০ ট্রলার ভেসে গিয়েছে সাগরে। আগামী শুক্রবার আরও আড়াইশো ট্রলার-নৌকোর ইলিশ শিকারে যাওয়ার কথা। দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরামের সম্পাদক দেবাশিস শ্যামল বলেন, ‘‘গত মরসুমে দিঘা মোহনাতেই দেড় হাজার টন ইলিশ উঠেছিল। এ বার সেই পরিমাণ দু’হাজার টন ছাড়াবে বলেই মনে হয়।’’

সেই আশাতেই সাগর উজিয়ে রুপোলি ফসল খোঁজার এমন অভিযান। আর এই অভিযানের দিকেই এখন তাকিয়ে রাজ্যের মৎস্যপ্রেমীরা।

Sisherman Hilsa Sea
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy