পুঁজি প্রকৃতি। সহায় প্রশাসন। এই দুয়ের মেলবন্ধনে গড়ে উঠছে ‘হোম স্টে’। তৈরি হচ্ছে কর্মসংস্থান। বদলে যাচ্ছে জঙ্গলমহলের অর্থনীতি। একসময়ের অনাহারের গ্রাম আমলাশোল তো বটেই বদলে গিয়েছে বেলপাহাড়ির প্রত্যন্ত এলাকা কাঁকড়াঝোড়, বাঁশপাহাড়ি, কুলডিহা, কেকাবনির মতো এলাকাও।
এই সব এলাকার অনেককেই এখন আর কাজের জন্য ভিন্ রাজ্যে যেতে হয় না। ‘অতিথি দেব ভবো’ মন্ত্রে পাহাড়ি এলাকার মানুষের জীবনের পথ মসৃণ হয়েছে অনেকটাই। যেমন আমলাশোলের রঘুপতি মুড়া, স্বদেশ মুড়া, আনন্দ মুড়ারা একসময় কাজের জন্য বেঙ্গালুরু ও অন্ধ্রপ্রদেশে কাজে যেতেন। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা কিংবা স্ত্রী-সন্তানদের জন্য চিন্তা লেগেই থাকত। ওঁরা সকলেই এখন হোম স্টের কর্মী। প্রকৃতি তো বরাবরই অকৃপণ ছিল। কিন্তু আগে প্রশাসন এ ভাবে পাশে থাকত না। মিলত না আর্থিক সাহায্য। আর স্বনির্ভরতায় মানসিক ভাবে সহায় হওয়া তো দূর অস্ত। প্রকৃতি ছাড়াও সংস্কৃতিও যে পুঁজি হতে পারে ছিল না সে দৃষ্টিভঙ্গিও। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য নাচের দল গড়ে আয় করছেন মহিলা ও পুরুষরা। বাম আমলে ২০০৪ সালে অনাহারে সনাতন মুড়া-সহ পাঁচজন আদিবাসীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। সনাতনের বউমা শোভারানি মুড়া এখন নাচের দলে রয়েছেন। বছর তিনেক অগে এক হোম স্টের ম্যানেজার দীপঙ্কর হাজরা এলাকায় একটি নাচের দল গড়েছিলেন। সেই নাচের দলে এখন ২৬ জন রয়েছেন।
বছর তিনেক আগে আমলাশোল প্রথম হোম স্টে তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। এখন সেখানে সাতটি হোম-স্টে তৈরি হয়েছে। হোম-স্টে তৈরির জন্য জমি লিজ়ে দিয়ে যেমন টাকা পাচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারা। আবার হোম স্টেতে কাজ পাচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারা। সাতটি হোম স্টেতে এলাকার প্রায় জনা তিরিশ বাসিন্দা কাজের সুযোগ পেয়েছেন। শীতের মরসুমে আরও অনেকে কাজ পান। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর দু’বছর ধরে হোম স্টেতে কাজ করছেন মনোহর মুড়া। মনোহর বললেন, ‘‘মাসে আট হাজার টাকা বেতন পাচ্ছি। হোম স্টেতে এলাকার অনেকে কাজ পাচ্ছেন। বাইরে লোকজন কাজ করতে যাচ্ছেন না।’’ পাহাড়ের কোলে থাকা এক হোম স্টের ম্যানেজার সজল সানা বলছেন, ‘‘এখানে প্রত্যেকে প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে দেওয়া হয়। আমরা চাইছি এলাকার মানুষজন আরও বেশি করে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হোক।’’ চিত্তরঞ্জন মুড়া নামে এক যুবক হোম স্টে তৈরির জন্য জমি লিজে দিয়েছেন। চিত্তরঞ্জন বলছেন, ‘‘জমি দিয়ে বছরে মোটা টাকা পাচ্ছি। পাশাপাশি ওই হোম স্টের পর্যটকদের খাবার ও দেখাশোনার দায়িত্বে আমরা রয়েছি।’’ পাশেই ঝাড়খণ্ড সীমানার আমঝর্নাতেও একটি হোম স্টে হয়েছে।
আমলাশোলের পাশাপাশি কাঁকড়াঝোর, ঢাঙ্গিকুসুম-সহ বেলপাহাড়ির একাধিক জায়গায় গড়ে উঠছে হোম স্টে। পাশাপাশি ঝাড়গ্রাম গ্রামীণ ও জামবনিতে বেশ কিছু হোম স্টে গড়ে উঠেছে। ঝাড়গ্রাম জেলায় সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত হোম স্টের সংখ্যা ১০২টি। এর মধ্যে বেলপাহাড়িতে প্রায় ৫০টি রয়েছে। বেলপাহাড়ির আমলাশোল, কাঁকড়াঝোর ছাড়াও ঢাঙ্গিকুসুম, বালিচুয়া, গোয়ালবেড়া, চাকাডোবা, বাঁশপাহাড়ি, কুলডিহা, কেকাবনিতে হোম স্টে গড়ে উঠেছে। জেলাশাসক সুনীল আগরওয়াল বলেন, ‘‘হোম স্টে যে এলাকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ বদলে দিতে পারে তার প্রকৃক্ট উদাহরণ হল আমলাশোল। হোম স্টে তৈরির জন্য সরকারি ভর্তুকি মিলছে। অনেকের কাজের সংস্থান হচ্ছে। এর ফলে লোকজন কাজের জন্য কেউ বাইরে যাচ্ছেন না।’’
সমস্যা যে একেবারে নেই তা নয়। প্রথমত, গোপীবল্লভপুর ও নয়াগ্রামের দিকে সে ভাবে হোম স্টে গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত, বহু ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ সীমাবদ্ধ থাকে শুধুমাত্র পর্যটনের মরসুমে। তৃতীয়ত, বহু ক্ষেত্রে শবর পরিবারগুলিতে এই স্রোতে আনা যায়নি।
হয়তো এখনও অনেক পথ চলার বাকি। তবে দু’দশকে জঙ্গমহলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পবিবর্তন যেন নিজেই এক আস্ত রূপকথা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)